ওয়াটস, কোলেট ও বেটসন (Batson) আবার ৩১ মে ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখলেন নবাবকে ‘আপসের সুরে’ একটা চিঠি দিতে।৮৯ ড্রেক সেটাও অগ্রাহ্য করলেন। এদিকে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কলকাতার এজেন্ট শিববাবুর আপসচেষ্টা ড্রেকের আগ্রহের অভাবে ব্যর্থ হল। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ ও ইংরেজদের শর্তাধীন আত্মসমর্পণে ড্রেক খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। শিববাবুকে ড্রেক নাকি বলেছিলেন—সিরাজ যত তাড়াতাড়ি কলকাতা আসে ততই ভাল, তা হলে ড্রেক সিরাজের জায়গায় অন্য কাউকে নবাব করতে পারবেন।৯০ শিববাবু দ্বিতীয়বারের (১০ জুন) প্রচেষ্টায় ড্রেককে দিয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে একটি চিঠি লেখাতে সক্ষম হলেন কিন্তু সে-চিঠিতে যদি সমঝোতার কোনও সুর থেকেও থাকে, তা ড্রেকই ওই একই দিনে থানা ও সুখসাগরে নবাবের দুটি ফৌজি ফাঁড়ি আক্রমণ করার আদেশ দিয়ে বানচাল করলেন।৯১ নবাবের সঙ্গে একটা চুড়ান্ত বোঝাপড়ায় ড্রেক যে দৃঢ়সংকল্প তা ওয়াটস ও কোলেটের (তাঁরা তখনও নবাবের ফৌজের সঙ্গে কলকাতার পথে) চিঠির (১২ জুন) তিনি যে উত্তর দিচ্ছেন তা থেকে সুস্পষ্ট: ‘কাশিমবাজারে কোম্পানির যে-অবমাননা হয়েছে, তারপরে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসতে একেবারে নারাজ।’৯২ দু’পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসার শেষ চেষ্টা করেছিলেন ফরাসি কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী ও তখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক মার্কুইস দ্য সাঁ জাঁক (Marquis de St. Jacques) ১৩ জুন (নবাবের অজ্ঞাতে নিশ্চয়ই নয়, তার মানে নবাব তখনও পর্যন্ত একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আগ্রহী ছিলেন)। এর উত্তরে ড্রেক সাঁ জাঁককে জানিয়েছিলেন, তিনি যেন নবাবকে ছেড়ে ইংরেজদের দিকে চলে আসেন।৯৩ সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে, গভর্নর ড্রেকের মারমুখো ও অনমনীয় মনোভাব ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের ১৬ জুনের সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এ-প্রসঙ্গে কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:৯৪
এ কথা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোনও রাজার [দোষী] প্রজাকে একদল বিদেশি বণিক আশ্রয় দেবে?…কিংবা তাঁর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে রাজা সেই অপমান নির্বিবাদে মেনে নেবেন?…দূতকে (অপমান করে] তাড়িয়ে দেওয়াটা সারা পৃথিবীতেই রাজার অপমান বলে গণ্য হয়…
ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকেও এটা স্পষ্ট যে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজরাই বহুলাংশে দায়ী। ১৭৫৬ সালের জুন মাসের ঘটনাবলী নিয়ে জুলাই মাসে হুগলির ডাচ কুঠি থেকে এশিয়াতে তাদের প্রধান কার্যালয় ব্যাটাভিয়াতে জানানো হয় যে, ইংরেজরাই এ সংঘর্ষের জন্য মূলত দায়ী।৯৫ তা ছাড়া ড্রেক যখন সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ডাচদের সাহায্য করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তা করতে অক্ষমতা জানিয়ে লেখেন যে, ইংরেজরা যখন এ-ঘটনার জন্য নিজেরাই দায়ী, তখন নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা ডাচদের পক্ষে সম্ভব নয়।৯৬
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. S.C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. I. Introduction. p. liii.
২. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67, 75-77, 80, 91-92; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, IHR, pp. 7,8,11,12 মার্শাল এখন (Bengal, p.77) তাঁর আগের বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসেছে। আগে তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কে ধস নামে যখন সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করলেন।’ (East Indian Fortunes,, Oxford, 1976)। বেইলি এবং রজতকান্ত রায় এখনও বলছেন, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ আরও ‘ঘনীভূত হল যখন সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে তাদের ধনসম্পত্তি দখল করতে চাইলেন, Bayly, Indian Society, p. 47. Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 12; পলাশীর ষড়যন্ত্র, পৃ. ৩২।
৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 56, 63; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 6.
৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 163.
৫. Hill, I, p. XXXI; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.
৬. Hill, I, p. lii; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.
৭. Mss. Eur. D. 283,f. 26.
৮. লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতিকে (Court of Directors) লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 15-16.
৯. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা উইলিয়াম ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭; Beng. Letters Recd, vol. 23, f. 386.
১০. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ম্যাথিউ কোলেটের চিঠি, ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 129.
১১. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, 11. p. 162.
১২. Annex to Consults., 27 Nov. 1752, BPC, vol. 25, f. 30la.
১৩. BPC, Range 1, vol. 25, f. 251, 18 Sept. 1752.
১8. Quoted in K. K. Datta, Sirajuddaullah, p. 5.
১৫. ঐ।
১৬. Evidence of John Cooke, Orme Mss., India IV, ff. 804-5; Hill, III, p. 290.