তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগগুলি খুবই সঙ্গত। একটিও তাদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের মিথ্যা ওজর নয়। এ সময় বাংলায় উপস্থিত একজন ইংরেজ নাবিক, ডেভিড রেনি (David Rannie), জানাচ্ছেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের তিনটে অভিযোগই ‘অত্যন্ত খাঁটি’ (strictly true)।৭৮ এমনকী হিলও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে নবাবের ‘মিথ্যা ওজরগুলোর’ মধ্যে ‘কিছুটা সত্য’ ছিল।৭৯ তবে সিরাজদ্দৌল্লার ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘যেখানে ইংরেজদের মতো রাজ্যের পক্ষে হিতকারী জাতির সঙ্গে তাঁর মাতামহ নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন, সেখানে সিরাজদ্দৌল্লার মূর্খামি হয়েছিল যে তিনি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করেছিলেন।’৮০
সিরাজদ্দৌল্লা যা করেছিলেন তাকে কোনওভাবেই মূর্খামির দ্যোতক বলা যায় না। বাদশাহি ফরমানে ইংরেজদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তা সিরাজ কখনওই বাতিল করতে চাননি৷ ইংরেজরাই বরং ফরমানের শর্তাবলীর অপব্যবহার করছিল। সিরাজ শুধু চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা ফরমানের শর্তাবলী মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তা ছাড়া এটাও ঠিক নয় যে আলিবর্দি ইংরেজদের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ইংরেজদের আক্রমণ করা বা তাদের কুঠি দখল করা তাঁর কখনও প্রয়োজন হয়নি কারণ তারা তার আগেই তাঁর মতো শক্তিশালী নবাবের কথা বা নির্দেশ মাথা পেতে নিত, অগ্রাহ্য করতে সাহস করত না। সিরাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়ে যায়— ইংরেজরা তখন দরবারের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে, এমনকী সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে মদত দিতেও শুরু করেছে, যা আলিবর্দির সময় করতে তারা সাহস করত না।
সিরাজদ্দৌল্লার অভিপ্রায়: গভর্নর ড্রেকের মনোভাব
সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ—বাংলা থেকে তিনি ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। হিল হয়তো এটাকেই সিরাজের মূর্খামির চূড়ান্ত ভেবেছেন। এ-ধারণা ঐতিহাসিক মহলে এতদিন ধরে চলে এসেছে এবং এতই স্বতঃসিদ্ধ বলে গৃহীত যে অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থেও বলা হচ্ছে যে, সিরাজদ্দৌল্লা ‘বাংলা থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।’৮১ কিন্তু তখনকার তথ্যপ্রমাণ থেকে এ-অভিযোগ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা অসুবিধে হবে না। খোজা ওয়াজিদকে লেখা চিঠিতে (২৮ মে ১৭৫৬) সিরাজ ইংরেজদের সম্বন্ধে তাঁর অভিপ্রায় পরিষ্কার করে জানিয়েছিলেন:৮২
ইংরেজরা আমার রাজ্যে থাকতে চাইলে তাদের দুর্গগুলি ভেঙে ফেলতে হবে, পরিখা ভরাট করে দিতে হবে এবং জাফর খানের (মুর্শিদকুলি খান] আমলে যে-শর্তে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে সেই শর্তেই তাদের এখন তা করতে হবে। তা না হলে আমার রাজ্য থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। তারা যেন মনে রাখে আমিই এ রাজ্যের নবাব। ইংরেজরা যাতে পূর্বোক্ত শর্তগুলি মেনে চলে, সে ব্যবস্থা করতে আমি বদ্ধপরিকর।
এর ক’দিন পরে ওয়াজিদকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে (১ জুন, ১৭৫৬) সিরাজ আরও জানাচ্ছেন: ‘ইংরেজরা যদি তাদের উপরোক্ত আচরণগুলি সংশোধন করবে বলে কথা দেয়, তা হলে আমি তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেব এবং তাদের আমার রাজ্যে থাকতে দেব।’৮৩ এ চিঠিগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা আসলে চেয়েছিলেন, ইংরেজরা যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজকর্ম ১৭১৭ সালের ফরমানের শর্তগুলি মেনে করে এবং ওই ফরমানে তাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার যেন যথেচ্ছ অপব্যবহার তারা না করে। তিনি যে ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাননি সেটা ফোর্ট সেন্ট জর্জের (Fort St. George—মাদ্রাজ) গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা তাঁর চিঠিতে সুস্পষ্ট: ‘সুবা বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া বা এখান থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়া মোটেই আমার অভিপ্রায় নয়।’৮৪ অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকও বলছেন: ‘ইংরেজরা যদি জাফর খানের আমলে যে-শর্তে বাণিজ্য করত সে-শর্তেই যদি আবার তা করতে রাজি না হয়, তা হলে সিরাজদ্দৌল্লা বাংলায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে এবং বাংলা থেকে তাদের বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।’৮৫ তবে এটা ঠিকই অল্প বয়সের ক্ষমতার দম্ভে ও অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি বাংলা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য মনে হয় নেহাতই ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য যাতে তারা তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নেয়।
নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যে-সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের আগের যে-ঘটনাবলী তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ইংরেজদের, বিশেষ করে গভর্নর ড্রেকের, কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ-সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধার তিন দিন আগে পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল মূলত ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। লন্ডনের পরিচালক সমিতি, মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল ও ফলতাতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে ওয়াটস ও কোলেট বার বার জোর দিয়েছেন যে, ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আগ্রহই দেখায়নি।৮৬ কাশিমবাজার থেকে কলকাতা অভিযানের পথে ওয়াটস ও কোলেট এক গোপন পত্রে দুর্লভরামের সঙ্গে মিটমাটের আলোচনার বিবরণ দিয়ে ড্রেককে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াটস লিখেছেন: ‘ড্রেক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে কোনও সাড়াই দেয়নি,নবাবের সঙ্গে কোনও মীমাংসায় যেতে তারা [ড্রেক ও কাউন্সিল] একেবারেই নারাজ।’৮৭ জাঁ ল’-র অবশ্য বিশ্বাস যে, ইংরেজরা ভেবেছিল একটু শক্ত ও কঠোর মনোভাব দেখালে নবাব ভয় পেয়ে মুর্শিদাবাদ পালিয়ে যাবেন।৮৮ এটাও হয়তো সম্ভব যে ড্রেক ভেবেছিলেন নবাবের অভিযোগগুলি ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়নের এবং তাদের ধনসম্পত্তি দখল করার জন্য নবাবের মিথ্যে অজুহাত। তাই হয়তো ড্রেক সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে নবাবকে কাবু করতে চেয়েছিলেন।