কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখছেন ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, দরবারের গুপ্তচরেরা ‘দস্তক নিয়ে এই বেশ্যাবৃত্তির’ খবর রোজ দরবারে পৌঁছে দিত।৬৯ এখানে মনে রাখা দরকার, সিরাজদ্দৌল্লা কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যেটা, সেটা তখনও তোলেননি। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের ভাঁওতা দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ব্যাপারে যে শুল্ক ফাঁকি দিত সেটা জেনেও সিরাজদ্দৌল্লা সে-অবৈধ অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি প্রধানত কোম্পানির কর্মচারীরা মোটা টাকার বিনিময়ে দস্তকের মাধ্যমে এশীয় ব্যবসায়ীদের যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত তাতেই বিশেষ আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্ব হানি হচ্ছিল তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক জানাচ্ছেন: ৭০
সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্ত দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
বাংলায় প্রশীয় কোম্পানির অধিকর্তা জন ইয়াং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব এবং দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের কারণ জানাতে গিয়ে গভর্নর ড্রেককে লিখেছিলেন: ‘এদেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করার জন্য আপনাদের দস্তকের যে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়মিত বেশ্যাবৃত্তির পর্যায়ে পড়ে। এতে নবাবের যথেষ্ট রাজস্ব হানি হচ্ছে এবং এটা তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলেই তিনি আপনাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন।’৭১ এমনকী হিল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে:৭২
ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যে-সব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তার অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজরা দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।
ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, দস্তক নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে মিথ্যা অজুহাত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান
নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই প্রজাদের, যারা অপরাধী হিসেবে নবাবের বিচারসাপেক্ষ, কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দিও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।৭৩ আমরা আগেই দেখিয়েছি, আমাদের হাতে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ ন্যায়সঙ্গতভাবেই কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভের বিরুদ্ধে ঢাকায় সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে-সব হিসেবপত্র যখন পরীক্ষা করা হচ্ছিল, রাজবল্লভ তখন ওয়াটসকে অনুরোধ জানান কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেবার জন্য। কাশিমবাজার থেকে ওয়াটসই গভর্নর ড্রেকের কাছে কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের সুপারিশ করেছিলেন। ওয়াটসের ধারণা ছিল, ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্যলাভ করবে। ওয়াটস লেখেন যে রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে।৭৪ কিন্তু আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। তখন তিনি ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে জানিয়ে দিলেন যে কৃষ্ণদাসকে এ-অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।৭৫ ড্রেক কিন্তু তাতে কর্ণপাতও করলেন না, যদিও কাউন্সিলের দুই সদস্য হলওয়েল ও ম্যানিংহাম অভিমত দিয়েছিলেন যে, এ-অবস্থায় কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় রাখা ঠিক নয়। কারণ তা হলে নতুন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে।৭৬ অবশ্য হলওয়েল যথারীতি কদিন পরেই মত পালটে ছিলেন কেননা তখন বাজারে গুজব যে, ঘসেটি বেগমের দল হয়তো জিততেও পারে। তাই হলওয়েল লিখেছেন: ‘কৃষ্ণদাসকে এ সময় কলকাতা থেকে বার করে দেওয়া কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে।’৭৭ যা হোক, এটা সুস্পষ্ট যে কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, সিরাজের যে-বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার যে-অভিযোগ, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।