অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬২ কিন্তু লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি এ-বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করে। কাউন্সিল লন্ডনে পরিষ্কার লেখে যে, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা শক্তিশালী করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের’ (অবশ্যই নবাব) বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার জন্য।৬৩ এর আগেই আমরা দেখেছি, ড্রেক এবং ম্যানিংহামও লন্ডনে লিখেছিলেন যে দুর্গকে দুর্ভেদ্য করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে।’ এ-সব তথ্য থেকে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের এ-প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:৬৪
নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just policy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ইংরেজরা যদি জাফর খানের [মুর্শিদকুলি খান] সময় তারা যে-ভাবে বাংলায় ব্যবসাবাণিজ্য করত সে অবস্থায় ফিরে না যায়, তা হলে তিনি তাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে ছাড়বেন। এটা স্পষ্ট যে সিরাজদৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের প্রতি কোনও বিরূপ বা শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য তাদের দুর্গ শক্তিশালী করাতে নবাব আপত্তি জানাননি। সিরাজদ্দৌল্লা সব ইউরোপীয়দেরই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাঁ ল’-র লেখা থেকে জানা যায় যে, নবাব একই সময় ইংরেজ এবং ফরাসি দু’পক্ষকেই আলিবর্দির রাজত্বের শেষ দিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ল’-কে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি দুর্গের সংস্কারে আপত্তি করছেন না, করছেন নতুন নির্মাণকার্যে। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেছল।৬৫ কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ। এমনকী হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, ইংরেজরা তাদের দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে তাদের ‘অধিকারের সীমা অতিক্রম’ করেছিল এবং নবাবের ‘অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬৬ সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ-ব্যাপারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর মিথ্যা ওজর বলে নস্যাৎ করা যায় না।
দস্তকের অপব্যবহার
দস্তকের অপব্যবহার সম্বন্ধেও সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের সাহায্যে কোম্পানির কর্মচারীরা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী তারা এ-দস্তক এশীয় বণিকদের কাছে বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্যও কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্যপ্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য দাবি করত যে, ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়র যে ফরমান বা আদেশপত্র ইংরেজ কোম্পানিকে দিয়েছিলেন তা শুধু কোম্পানির আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকেও শুল্কমুক্ত করে দিয়েছিল। এই দাবি কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত। যে-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষিতে ওই ফরমান দেওয়া হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে অনেকদিন আগেই আমরা দেখিয়েছি যে, ১৭১৭-এর ফরমান শুধু কোম্পানির আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকেই শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে নয়।৬৭
ফলে মুর্শিদকুলির সময় থেকেই এ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলার শাসকদের প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ লেগে থাকত। কখনও কখনও ওই বিবাদের সুযোগ নিয়ে বাংলার নবাবের আদেশে কোম্পানির বেচাকেনা একদম বন্ধ করে দেওয়া হত। বিরোধ যখন চরমে উঠত তখন বেগতিক দেখে কোম্পানি নবাব ও তাঁর অমাত্যদের মোটা নজরানা দিয়ে মীমাংসা করে নিত। কখনও বা ইংরেজরা পালটা ব্যবস্থা হিসেবে হুগলি নদীতে এশীয়দের বাণিজ্যতরী আটকে দিত। আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার নবাবের হাতে ন্যায্য হাতিয়ার তুলে দিয়েছিল যাতে নবাব ইচ্ছে করলে কোম্পানির বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারতেন।’ ওই লেখক আরও বলেছেন: ‘দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে কোম্পানির কাছ থেকে নবাব মোটা টাকা আদায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এভাবে টাকা আদায় করাটা নবাবের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা যায় না।’৬৮ দস্তকের অন্যায় অপব্যবহারের প্রশ্ন আগের নবাবরাও তুলেছিলেন, সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম নন। তবে তিনি এই অবৈধ ও বে-আইনি ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই হয়তো কোম্পানির কর্মচারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে এটার মাধ্যমে তাদের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ ও লোভনীয় উপায়টি এবার বন্ধ হয়ে যাবে।