ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:
ন্যায়সঙ্গত না শুধু মিথ্যা ওজর?
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার তিনটে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং আমাদের কাছে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে স্পষ্ট যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত। এগুলিকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য ‘শুধু মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:
(১) ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য এবং সুসংহত করার প্রচেষ্টা।
(২) দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ অপব্যবহার।
(৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান।
খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে একটা চিঠিতে ইংরেজদের প্রসঙ্গে তাঁর নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন:৫৪
তিনটে মুখ্য কারণে আমি আমার রাজ্য থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চাই। প্রথমত, দেশের কোনও আইনকানুন না মেনে তারা বাদশাহি মুলুকে [বাংলায়] গড়খাই কেটে জোরদার কেল্লা বানিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, এমন সব লোককে দস্তক দিয়েছে যারা কোনওমতেই তা পেতে পারে না এবং তাতে বাদশাহের [রাজ্যের] রাজস্বের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তৃতীয়ত, নবাবকে অগ্রাহ্য করে নবাবের অপরাধী প্রজাদের নবাবের বিচারের হাত থেকে তাদের রেহাই দিতে কলকাতায় আশ্রয় দিচ্ছে।
কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ
উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা দরকার। তখনকার সব সরকারি নথিপত্র থেকে স্পষ্ট, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার জমিদার শোভা সিং-এর বিদ্রোহের সময় বাংলার সুবাদার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে তাদের কেল্লা সুসংহত করার যে ঢালাও অনুমতি দেন, তার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল।৫৫ আবার, ১৭৪০-এর দশকে মারাঠা আক্রমণের সময় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারিদিকে গড়খাই খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি, ১৭৫২), ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।৫৬ এর আগেও অবশ্য তারা কলকাতাকে জানিয়েছিল (১৭ জুন ১৭৪৮) যে বাংলার নবাব যদি কেল্লা সুরক্ষিত করার অনুমতি দিতে না চান তবে যেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয় যে, এর ফল দেশের এবং দেশের রাজস্বের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইংল্যান্ডের রাজা কোম্পানির হিতাকাঙক্ষী। ফলে কোম্পানি যা করবে, তিনি তা সমর্থন করবেন।৫৭ এমনকী ১৭৫৪ সালেও কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় লিখছে, নবাবকে বোঝাতে যে, ইংরেজদের কেল্লা সুসংহত করার মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির অর্থসম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।৫৮ এ থেকে স্পষ্ট, ফরাসিদের হাত থেকে ইংরেজদের রক্ষা করতে নবাবের সাধ্যে কুলোবে কি না সে-বিষয়ে ইংরেজরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিল এবং এটা সিরাজদ্দৌল্লার শ্লাঘায় আঘাত করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করার জন্য বেশ সচেষ্ট ছিল। ১৭৫৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ড্রেক ও ম্যানিংহাম (Manningham) কলকাতা থেকে লন্ডনে যে চিঠি লেখেন তা থেকে এটা পরিষ্কার:৫৯
কর্নেল স্কটের [Colonel Scott] মৃত্যুতে [কলকাতার কেল্লাকে দুর্ভেদ্য করার] তাঁর যে পরিকল্পনা (দেশীয় [নবাবের] আক্রমণ থেকে আমাদের বসতিকে রক্ষা করার জন্য) তা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাতে যে পরিমাণ খরচ হবে তা করতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনারা তা অনুমোদন করার ফলে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করার চেষ্টা করব। তবে আবহাওয়া কেমন থাকে তার ওপর কাজের অগ্রগতি কিছুটা নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, নবাবি সরকারের মনোভাব যদিও বেশ কঠিন, এখনও পর্যন্ত আমাদের কাজে বাধা দিতে তারা কোনও চেষ্টা করেনি।
বলা বাহুল্য, লন্ডনের পরিচালক সমিতি কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করার জন্য স্কটের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিল।
এদিকে ড্রেক ও ম্যানিংহাম ওয়াটসের অভিমত চাইলেন, কর্নেল স্কটের পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে নবাবের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না এবং না-নিলে কোনও ঝামেলা হতে পারে কি না তা জানতে। তার উত্তরে ওয়াটস জানালেন: ‘কলকাতার কেল্লা সুরক্ষিত করার ব্যাপারে আগে থেকে নবাবের অনুমতি চাওয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ নবাব যদি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন, তা হলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বাতিল করতে হবে। নয়তো নবাবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাদের এগোতে হবে।’৬০ বাংলার নবাবের কর্তৃত্বকে ইংরেজরা এ সময় কী রকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা করতে শুরু করে, ওয়াটসের এই বিধি তার নিদর্শন। ওয়াটস আরও লিখেছেন: ‘নবাব আলিবর্দির হয়তো চোখেই পড়বে না যে আমরা কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করে তুলছি। সুতরাং নবাবের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজটা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেওয়াই উচিত।’৬১ গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলকাতার কেল্লা আরও দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী করে তোলার কাজ শুরু করে দিল।