অবশ্য অনেকদিন আগেও কোনও কোনও বাঙালি ঐতিহাসিক, নাট্যকার, প্রমুখ ওপরের বক্তব্যগুলির, বিশেষ করে সিরাজদ্দৌল্লা সম্বন্ধে, বিরোধিতা করেছেন, যেমন অক্ষয়কুমার মৈত্র (সিরাজদ্দৌল্লা), শচীন সেনগুপ্ত (সিরাজদ্দৌল্লা) (নাটক), প্রভৃতি। তবে এগুলি জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে লেখা, তথ্যের চেয়ে ভাবাবেগই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তা ছাড়া তাঁদের পক্ষে বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভসে গবেষণা করাও সম্ভব ছিল না। ষাটের দশকে ব্রিজেন গুপ্ত ওপরের কিছু কিছু বক্তব্য খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সবগুলি প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি। অন্যদিকে কালীকিঙ্কর দত্ত মূল প্রশ্নগুলিকে প্রায় এড়িয়েই গেছেন। তাই আমরা এখানে যা বলতে চেয়েছি তা সম্পূর্ণ নতুন এবং তথ্যভিত্তিক।
এখানে আমাদের মূল বক্তব্য, পলাশির ষড়যন্ত্রে ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই এ-কাজ সম্পন্ন করে, এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে। তবে এটাকে দেশীয় চক্রান্তকারীদের দোষ স্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। নবাবের দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা অংশ সিরাজদ্দৌল্লার ওপর বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, এ-কথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে-বক্তব্যের ওপর জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই চক্রান্ত পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না।
তবে এটা মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশি বিপ্লব ও ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ নয়। বস্তুত, লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি এরকম পরিষ্কার কোনও নির্দেশ কখনও দেয়নি। আসলে ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই। এই কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—এখানে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে অল্প সময়ে প্রচুর ধনোপার্জন করে দেশে ফিরে তোফা আরামে বাকি জীবনটা কাটাবে বলে। কোম্পানির কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০-এর দশক থেকে ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু তারপরে এই ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের সম্মুখীন হয়—বিশেষ করে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে। তার ওপর বাংলার নবাবদের মধ্যে এই প্রথম তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার পরে ঘোষণা করলেন যে তিনি ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের বে-আইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও তাদের দস্তকের (যা দিয়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করা যেত) যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর। সুতরাং এই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করতে একদিকে সিরাজদ্দৌল্লাকে এবং অন্যদিকে ফরাসি ও আর্মানিদের হঠানো অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেজন্যেই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব, যাতে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ইংরেজরা কুক্ষিগত করতে পারে এবং ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের আবার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
মোট এগারোটি অধ্যায়ে আমরা আমাদের বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই ‘ভূমিকা’-তে আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে নবাবি আমলে বাংলার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা। পরের অধ্যায়ে সিরাজ-চরিত নিয়ে যে-সব ফারসি ও ইউরোপীয় বৃত্তান্তের ওপর সাধারণত নির্ভর করা হয়, সেগুলির দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে পলাশির প্রেক্ষিতে বাংলায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ সময়, এমনকী মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও, বাংলা থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সম্মিলিত মোট রফতানির চেয়েও অনেক বেশি ছিল। ফলে এশীয় বণিকরাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। পরবর্তী অধ্যায়ে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ও সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট ও মূল কারণগুলি নির্দেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব কেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে। এখানে বলা হয়েছে বাংলায় কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকট তখন ছিল না, সমাজও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েনি, আর ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসও অচল। সপ্তম অধ্যায়ে আছে পলাশি চক্রান্তের সূচনা, বিকাশ ও রূপায়ণের সম্যক বিশ্লেষণ। তার পরের অধ্যায়ে ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের, ইংরেজ ও দেশীয় দু’তরফেরই, বিস্তৃত পরিচিতি, কার্যকলাপ ও চক্রান্তে তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকার বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে ইংরেজরা কীভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে ফেলে, মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরেও তাড়াতাড়ি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য ইংরেজদের যে অস্থিরতা, মীরজাফরকে একদিকে প্রচ্ছন্ন ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে অন্যদিকে কাকুতিমিনতি করে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার জন্য পীড়াপীড়ি, এ-সব ইংরেজদের লেখা থেকেই দেখানো হয়েছে। আর পলাশির পরে ইংরেজরা কীভাবে বাংলায় অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু করে দেয়, কীভাবে উত্তর-পলাশি পর্বে তারা বাংলা থেকে বিরাট ধন নিষ্কাশণের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং কীভাবে তারা বাংলার অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তার বিস্তারিত আলোচনা আছে দশম অধ্যায়ে। শেষ অধ্যায়ে উপসংহার—এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার।
১. প্রাক্-পলাশি বাংলার রূপরেখা
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।১ বস্তুতপক্ষে, সুবে বাংলা প্রায় দু’শো বছর ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সুবা (প্রদেশ) হিসেবে গণ্য হয়েছে। বাংলার উর্বর জমি, বিভিন্ন রকমের অপর্যাপ্ত কৃষিজ পণ্য, অসংখ্য নিপুণ তাঁতি ও অন্যান্য কারিগর, উন্নত বাণিজ্যিক ও আর্থিক সংগঠন এবং সস্তা অথচ উৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব মিলে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অত্যন্ত মুল্যবান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই বাংলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর বাংলা যেহেতু সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বাংলায় একমাত্র সোনা-রুপো ছাড়া অন্য কিছুর বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে বাংলা থেকে যারা পণ্য রফতানি করত, তাদের সবাইকে—সে ইউরোপীয় বা এশীয় বণিক যেই হোক না কেন—এ-সব পণ্য কেনার জন্য বাংলায় সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসতে হত।২