এর পরের যে ঘটনাবলী তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা এতসব সত্ত্বেও দম্ভসূচক বা হঠকারিতার কোনও কাজ করেননি। তিনি তাঁর দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অমাত্যদের ডেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাইলেন। মুজাফ্রনামা-র লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী, সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন, জয়নাল আবেদিন, মীর্জা হাবিব বেগ, মীর হাসাউল্লা প্রমুখের নেতৃত্বে একদল পরামর্শ দিল, ইংরেজদের না ঘাঁটাতে, তারা ‘আগুনের শিখার মতো’ (‘flames of fire’), অন্যদিকে খোজা ওয়াজিদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর প্রমুখের নেতৃত্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী পরামর্শ দিল, ইংরেজদের প্রতি ‘দৃঢ় কূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণের নীতি’ (‘a policy of firmness and diplomacy combined with a show of force’) অবলম্বন করতে।৩৭ সেই (দ্বিতীয়) পরামর্শ অনুযায়ী সিরাজদ্দৌল্লা প্রখ্যাত আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করলেন। ওয়াজিদের নিযুক্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে নেবার জন্য তরুণ নবাবের সদিচ্ছারই প্রমাণ। এই দৌত্যের কাজে ওয়াজিদই যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই, কারণ এই আর্মানি বণিক তখন বাংলার অগ্রণী ব্যবসায়ীদের অন্যতম এবং ইংরেজ সমেত ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তাঁর সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেন এবং তাঁকে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন। উইলিয়াম ওয়াটসের লেখা থেকে জানা যায়, ওয়াজিদ চার বার কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করে নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে এই বলে শাসিয়েছিল যে এরকম প্রস্তাব নিয়ে ওয়াজিদ যেন আর কলকাতায় আসার চেষ্টা না করেন।৩৮ এমনকী বাংলায় প্রুশীয় (Prussian) কোম্পানির প্রধান জন ইয়াং (John Young) নবাব ও বাংলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন:৩৯
[ইংরেজদের সঙ্গে] মিটমাটের জন্য যখন ফখর-উৎ-তুজ্জার [ওয়াজিদ] গেছলেন বা তাঁকে পাঠানো হয়েছিল—কোনটা আমি ঠিক জানি না, কতবার তাও না—তখন আপনারা [ইংরেজরা] নাকি কোনও কথায় কর্ণপাত করতে বা কোনও কিছু মেনে নিতে একেবারে অনিচ্ছুক ছিলেন। উপরন্তু আপনারা নাকি তাঁকে এ-কাজে আবার না আসার জন্য শাসিয়েছিলেন।
খোজা ওয়াজিদ যখন নিষ্ফল দৌত্যে ব্যস্ত, সিরাজদ্দৌল্লা তখন দুর্লভরাম ও হাকিম বেগকে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পুর্ণিয়া অভিমুখে রওনা হন।৪০ কিন্তু রাজমহল পৌঁছে ইংরেজদের উদ্ধত আচরণের, ড্রেকের চিঠির এবং নারায়ণ সিং-এর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎগতিতে কাশিমবাজারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে, ২৪ মে তিনশোর মতো নবাবের সৈন্য কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির সামনে উপস্থিত হয়। সিরাজদ্দৌল্লা কাশিমবাজার পৌঁছলেন ৩ জুন, তখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা ৩০,০০০।৪১ ৪ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজকুঠি বিনা প্রতিরোধে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস সিরাজের নির্দেশে এক চুক্তির শর্তাবলীতে স্বাক্ষর করলেন। এই শর্তগুলি হল: (১) নবাবের কোনও অপরাধী প্রজাকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়া চলবে না (২) ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করেছে, তা ভেঙে দিতে হবে (৩) এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাছে ইংরেজরা দস্তক বিক্রি করতে পারবে না।৪২ এ থেকে পরিষ্কার, শর্তগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের নির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে রচিত—অভিযোগগুলি আমরা পরে খতিয়ে দেখব। কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা ৫ জুন কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর নির্দেশে কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস এবং কোলেটও নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা চললেন। সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছুতে হাত দেননি বা বাজেয়াপ্ত করেননি—কোনও লুঠতরাজ বা হত্যাকাণ্ড হয়নি। কোনও নিষ্ঠুরতাও নয়।৪৩
এ পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার সম্পর্কে তাঁর কোনও দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কলকাতা আক্রমণ করার আগে (১৬ জুন) সিরাজ আপস-মীমাংসার জন্য ইংরেজদের অনেক সময় দিয়েছিলেন, প্রথমে অস্ত্রধারণ না করে শুধু কূটনীতি ও দৌত্যের মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। তা যখন ব্যর্থ হল, তখনই তিনি একদিকে দৌত্য এবং অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করলেন। কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করার পেছনে বোধহয় সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল, ওখানে ইংরেজদের নিরস্ত্র করে ওই কুঠির প্রধান ওয়াটসের মাধ্যমে কলকাতায় ইংরেজদের ওপর নবাবের সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। ওয়াটসের সঙ্গে চুক্তির যে শর্তাবলী, সেগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের ওপর ভিত্তি করা এবং মোটেই অযৌক্তিক কিছু নয়। তা ছাড়া এরকম ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কোম্পানির কুঠি অবরোধ করা নতুন কিছু নয়, সিরাজের আগের নবাবরাও তা করেছেন। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ সম্বন্ধে রিচার্ড বেচারের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৪৪