আগেই বলা হয়েছে প্রথমদিকে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন না। সিরাজ মসনদে বসার অনেক আগেই আলিবর্দি ইংরেজদের দেওয়া এক পরোয়ানায় জানিয়েছিলেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা সবসময় আলিবর্দির সমক্ষে ইংরেজদের প্রশংসা করতেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শুভকামনা করতেন।১২ ১৭৫২ সালের মে মাসে আলিবর্দি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন আর ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই হুগলির ফৌজদার ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের পরামর্শে ইংরেজরা সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্র থেকে জানা যায়, সিরাজ ‘ইংরেজদের প্রতি ডাচ বা ফরাসিদের চেয়েও বেশি সৌজন্য দেখান এবং যথেষ্ট হৃদ্যতামূলক আচরণ করেন।’১৩ নবীন যুবরাজের সহৃদয় ব্যবহারের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি লন্ডন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে লিখে পাঠায় (২৩ জানুয়ারি ১৭৫৪) যে ‘তারা যেন ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার এই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের আরও উন্নতি করে।’১৪ আবার আরেকটি চিঠিতে পরিচালক সমিতি জানাচ্ছে (২৪ নভেম্বর, ১৭৫৪), সিরাজ অন্য ইউরোপীয়দের চেয়ে ইংরেজদের প্রতি অনেক বেশি প্রসন্ন বলে মনে হচ্ছে এবং এটাকে যেন কাজে লাগানো হয়।১৫
সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে সিরাজ নবাব হওয়ার পর তখনকার রীতি অনুযায়ী ইংরেজরা তাঁকে কোনও নজরানা বা উপঢৌকন দেয়নি বলে তিনি ইংরেজদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক নয়। ইংরেজরা একটি চিঠি লিখে সিরাজকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং নতুন নবাবের কাছ থেকে অনুগ্রহ ও নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিলেন। এ চিঠি বেশ সাদরেই গৃহীত হয়েছিল। তরুণ নবাব দরবারে ইংরেজদের ‘ভকিল’ (vakil) বা প্রতিনিধিকে জানিয়ে দেন যে তিনি ইংরেজদের প্রতি তাঁর মাতামহ আলিবর্দির চেয়েও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবেন।১৬ আসলে ইউরোপীয়দের প্রতি আলিবর্দির নীতি ছিল ‘ঋজু অথচ অন্যায্য নয়’ (rigid rather than unjust)। যাতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল তা হল, ইউরোপীয়রা নবাবের অধীন নয়—স্বাধীন, নবাবের তারা তোয়াক্কা করে না এমন মনোভাব। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন, ‘আলিবর্দি কিন্তু ভালভাবেই জানতেন ঠিক কখন এবং কীভাবে এদের সমঝে দেওয়া প্রয়োজন যে তিনিই বাংলার হর্তাকর্তা। তিনি চেয়েছিলেন যে ইউরোপীয়রা কেউই বাংলায় দুর্গ তৈরি করে নিজেদের সুসংহত না করে।’১৭ তিনি দরবারে এ-সব কোম্পানির প্রতিনিধিদের বলতেন—‘তোমরা সওদাগর, তোমাদের দুর্গ তৈরি করার প্রয়োজনটা কী? আমার রাজ্যে তোমাদের এমন কোনও শত্রু নেই যাকে তোমরা ভয় করতে পার।’ তিনি আরও বলছেন, ‘আলিবর্দি যদি আর কিছুদিন সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতেন, তা হলে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপীয়দের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর উত্তরসূরিকেই সেই কাজ করতে এগিয়ে আসতে হল।’১৮ সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি বেশ সন্তুষ্টই ছিলেন। তারাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে রায়দুর্লভ ও মোহনলালের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলত।১৯
কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে, দু’পক্ষের স্বার্থের মধ্যে সংঘাতের ফলে, বিরোধ অপরিহার্য হয়ে উঠল। আসলে আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে সিরাজ ইংরেজদের কিছু কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ এগুলির মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় এবং আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদে মসনদ নিয়ে বিরোধ অবধারিত ভেবে ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই প্রায় প্রকাশ্যে তাদের দুর্গগুলি সংস্কার ও সংহত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলিবর্দি অত্যন্ত অসুস্থ এবং অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে অভিযান করবে এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সিরাজ আপাতত ইংরেজ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হলেন।২০
সিরাজদ্দৌল্লার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হওয়ার আরও গভীর কারণ ছিল। তিনি আশঙ্কা করেন যে ইংরেজরা তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির বিরোধিতা করতে পারে। তিনি যখন ১৭৫৬-এর এপ্রিলে নবাব হলেন তখন তাঁর সন্দেহ হয় যে ইংরেজরা মসনদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিচ্ছে। এ-সন্দেহ কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। বস্তুত ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল, সিরাজের পক্ষে নবাব হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান রেনল্ট বা জা ল’র লেখা থেকে এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইউরোপীয় তথ্য থেকেও জানা যায় যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে একটা মতলব ভাঁজছিল এবং সিরাজের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রেনল্ট স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ‘ঘসেটি বেগমের দলকে মসনদ দখলের দৌড়ে কেউ আটকাতে পারবে না এবং সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য, এই স্থির বিশ্বাসে ইংরেজরা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে [সিরাজের বিরুদ্ধে] চক্রান্ত শুরু করেন।’২১ জাঁ ল’-ও লিখছেন যে অন্য অনেকের মতো ইংরেজরাও ভেবেছিল, ‘সিরাজদ্দৌল্লা কখনও নবাব হতে পারবেন না, এবং তাই তারা কোনও কাজে তাঁর দ্বারস্থ হত না। শুধু তাই নয়, তারা তাঁর সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগই রাখত না।’ এ-সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:২২