অধুনা ঐতিহাসিকদের মধ্যে যদিও পিটার মার্শাল বলছেন যে, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে ‘মিটমাট করার জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়নি’ তবু তিনি এবং অন্যান্যরা এখনও প্রচ্ছন্নভাবে এ-সংঘর্ষের জন্য সিরাজদ্দৌল্লাকেই বেশি করে দায়ী করেছেন।২
ইদানীং ঐতিহাসিকরা বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে বিরোধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে বাংলায় নবাবের সঙ্গে সামরিক অভিজাতশ্রেণী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জমিদারদের মধ্যে যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা (new class alliance) তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি খান পর্যন্ত বাংলায় নবাবি শাসনের মূল ভিত্তি, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা ভেঙে পড়ে।৩ তার ফলেই তরুণ নবাবের সময় বাংলার রাজনৈতিক জীবনে ‘সংকট’ ঘনীভূত হয়। আর সেই সুযোগেই ইংরেজরা বাংলায় নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এটা ঠিকই, ১৭৫৬-৫৭ সালে বাংলায় যে ‘সংকটে’র কথা বলা হয় তা সম্যক উপলব্ধি করতে গেলে, বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে যে-সম্পর্ক তা ভাল করে বুঝতে হবে। এ-সম্পর্ক আবার অনেকটা নির্ভর করত একদিকে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির নিজস্ব অর্থাৎ কোম্পানির তরফে যে-সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সমৃদ্ধি বা অবনতির ওপর। কিন্তু যে-সব বিশেষ ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষের উৎপত্তি, সেগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে এ-সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল’ লিখেছেন যে নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর আগে থেকেই ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার বিরূপ মনোভাব ছিল।৪ কিন্তু এ বক্তব্য মোটেই সঠিক নয়। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা যখন নবাব হলেন, তখনও ইংরেজদের প্রতি তাঁর কোনও বিরূপতা ছিল না, কোনও শত্রুতামূলক মনোভাবও নয়। সাধারণভাবে ইউরোপীয়দের প্রতি, ইংরেজসমেত, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলিবর্দির মতোই। দু’জনেরই এদের প্রতি মনোভাব দক্ষিণ ভারত এবং কর্ণাটকের ঘটনার প্রেক্ষিতেই আবর্তিত হত। দক্ষিণ ভারতে যা ঘটছিল, সেখানে কীভাবে ইংরেজ ও ফরাসিরা রাজনীতির দাবাখেলায় মেতে উঠেছিল এবং কীভাবে স্থানীয় শাসকদের তাদের হাতের পুতুল করে তুলছিল, সে সম্বন্ধে আলিবর্দি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, ইউরোপীয়রা বাংলায়ও সে-খেলায় মেতে উঠতে পারে। তাই তারা যাতে বাংলায় তার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে তার জন্য তিনি সচেষ্ট ও বদ্ধপরিকর ছিলেন।৫ জাঁ ল’ বলছেন, আলিবর্দি ইংরেজ ও ফরাসিদের সমান সন্দেহের চোখে দেখতেন। তবে বৃদ্ধ নবাব বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলায় ফরাসিদের তুলনায় ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক বেশি ছিল— সুতরাং ফরাসিদের চেয়ে তারাই বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।৬ সিরাজদ্দৌল্লার উপলব্ধিও ছিল তাই। এটা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের পাণ্ডুলিপি থেকে সুস্পষ্ট: ‘নতুন নবাব তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত বোধ করছিলেন এবং তা হ্রাস করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এদের মধ্যে যেহেতু ইংরেজরাই বেশি শক্তিশালী, তাই তিনি ন্যায্যভাবে [just policy] প্রথমে তাদের দমন করতে অগ্রসর হলেন।’৭
হলওয়েল (Holwell) অবশ্য লিখেছেন যে আলিবর্দি অনেকদিন ধরে ইউরোপীয়দের অস্ত্রসম্ভার ও দুর্গ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং মৃত্যুশয্যায় সিরাজকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইংরেজদের প্রথম শায়েস্তা করতে এবং তাদের কোনও দুর্গ বা সৈন্যসামন্ত রাখতে না দিতে।৮ কিন্তু হলওয়েলের দেওয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। কলকাতার ‘অন্ধকূপ হত্যার’ যে-কাহিনী তার জনক তিনিই। তাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে অনেক ইংরেজ কর্মচারীই সন্দিহান ছিল। নিজের বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করতে বা তথ্যকে বিকৃত করতে তিনি বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। অন্য ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকে প্রমাণ করা যায় যে আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় সিরাজের প্রতি নির্দেশ একেবারেই আজগুবি গল্প। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস, যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের হাঁড়ির খবরও রাখতেন, জানিয়েছেন যে তিনি বা ওই কুঠির কেউ, এমনকী স্থানীয় লোকজনরাও মৃত্যুশয্যায় আলিবর্দির সিরাজের প্রতি নির্দেশের কথা শোনেননি।৯ ওই কুঠির দ্বিতীয় প্রধান ম্যাথু কোলেট (Mathew Collet) হলওয়েলের বক্তব্যকে ‘একেবারেই আজগুবি গল্প’ (spacious fable) আখ্যা দিয়েছেন।১০ এখানে স্মর্তব্য, এঁরা দুজনেই কাশিমবাজারে ছিলেন বলে পাশে মুর্শিদাবাদ দরবারে রোজ যা ঘটত, তার সবকিছুরই খবর রাখতেন। তাঁরা কিছু জানতেন না অথচ হলওয়েল কলকাতায় বসে কী করে সব জানলেন? ইংরেজ কোম্পানির আরেকজন কর্মচারী, রিচার্ড বেচার (Richard Becher) লিখেছেন: ‘ইংরেজরা এমন অনেক কাজ করেছে যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের ওপর রেগে গেছিলেন। তাদের প্রতি বিরূপ হওয়ার জন্য আলিবর্দির শেষ উপদেশের কোনও প্রয়োজনই ছিল না।১১