এশীয় বণিকরা যে বাংলায় ইউরোপীয়দের চেয়েও অনেক বেশি সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসত, তা মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ছিলেন এমন কয়েকজন ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বয়ান থেকে স্পষ্ট জানা যায়। এঁদের মধ্যে একজন উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts)। তিনি লিখেছেন, ভারত ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সওদাগর বাংলায় ব্যবসা করতে আসত এবং তারা বাংলায় পণ্য কেনার জন্য ‘শুধু টাকাপয়সা, সোনা-রুপো বা হুন্ডি’ নিয়ে আসত। তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘বাংলায় এশীয় বণিকদের মাধ্যমে যে-পরিমাণ সোনা-রুপো ও টাকাপয়সা আসত, তা ইউরোপ থেকে বা পারস্য ও আরব উপসাগরের সমুদ্রপথে আসা সোনা-রুপো ও নগদ টাকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।১২ আরেকজন ইংরেজ কর্মচারী হ্যারি ভেরেলস্ট (Harry Verelst) জানাচ্ছেন, ‘বাংলার পণ্যের বিনিময়ে বাংলায় আসত সোনা-রুপো এবং এভাবে যত বেশি পণ্য বাংলা থেকে রফতানি হত, তত পরিমাণ ধনসম্পদই প্রত্যেক বছর বাংলায় আসত।১৩ অন্য এক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন বলছেন, ‘এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিকরা শুধু নগদ টাকাকড়ি ও সোনা-রুপো দিয়ে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনতে আসত।’১৪ এ-সব বৃত্তান্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে মধ্য অষ্টাদশ শতকেও এশীয় বণিকরা বাংলায় সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানিতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল, ইউরোপীয়রা নয়। এবং সবাইকেই বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কেনার জন্য বাইরে থেকে সোনা-রুপো ও নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত।১৫
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিস্তৃত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 27-46.
২. হুগলি বন্দরের উত্থান ও আধিপত্য, S. Chaudhury, ‘The Rise and Decline of Hughli’, Bengal Past & Present, Jan-June, 1967, pp. 33-67.
৩. বিস্তারিত বিবরণের জন্য S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 28.
৪. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization in Bengal, pp. 196-97.
৫. Kristof Glamann, Dutch Asiatic Trade, p. 144.
৬. যেমন, Om Prakash, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal; P. J. Marshall, Bengal: the British Bridgehead; K. N. Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company. ইত্যাদি।
৭. যে-সব তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 202-13, 249-58.
৮. ঐ।
৯. Om Prakash, Dutch East India Company; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline.
১০. এই বইয়ের দশম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline,, pp. 30-31.
১২. William Bolts, Considerations on Indian Affairs, p. 200.
১৩. Harry Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC, Vol. 24. f. 324.
১৪. Luke Scrafton, Reflections, p. 20.
১৫. আমার একটি প্রবন্ধের ‘European Companies and Bengal’s Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993, 321-40), বক্তব্যের উত্তরে ওম প্রকাশ বলছেন ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry—A Reply, (Modern Asian Studies) পূর্বোক্ত সংখ্যা, পৃ. ৪১-৪৬) এশীয় বণিকরা অন্যান্য অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সিংহল থেকে, বাংলায় নানারকম পণ্য নিয়ে আসত এবং সেগুলি বিক্রি করে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনত। তাই তাদের বাইরে থেকে সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসার তেমন প্রয়োজন হত না। এ-বক্তব্য কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। এশীয় বণিকরা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০’-এর দশকে, ওই সব অঞ্চল থেকে কিছু কিছু পণ্য বাংলায় নিয়ে আসত সন্দেহ নেই কিন্তু তার পরিমাণ ও মোট মূল্য বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের যে বিপুল পরিমাণ রফতানি তার তুলনায় নিতান্তই নগণ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, অষ্টদশ শতকের প্রথমার্ধে এশীয় বণিকদের সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায় কারণ বাংলা থেকে সমুদ্রবাণিজ্য এখন দিক পরিবর্তন করে পূর্বমুখী থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে যায় এবং এই নতুন দিকের বাণিজ্যে এশীয়রা ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে কোনও সক্রিয় অংশ নিতে পারেনি। তা ছাড়া এই নতুন সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণও তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হত স্থলপথে এবং বাংলা থেকে এই স্থলবাণিজ্যের পণ্য ক্রয় করতে তাদের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত। এ-কথা ইউরোপীয় পর্যটক থেকে বাংলায় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। ডাচ কোম্পানি এশিয়ার মধ্যে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির সঙ্গে কিছু কিছু বাণিজ্য করত ঠিকই এবং সে-সব জায়গা থেকে বাংলায় পণ্য নিয়ে আসত। সেগুলি বিক্রি করে এবং এই আন্তঃএশীয় বাণিজ্যের মুনাফা দিয়ে বাংলার রফতানি পণ্য কিনত। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের এই বাণিজ্য অনেকটা কমে যায় ফলে তারাও আগে বাংলায় যে পরিমাণ পণ্য ওই সব অঞ্চল থেকে আনত, তা নিতান্তই নগণ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং ওই বাণিজ্যের মুনাফাও একেবারে কমে যায়। এ-সব দিক থেকে বিচার করলে ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে অসার হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও আশ্চর্য যে, কোনও কোনও ঐতিহাসিক ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে এবং তাঁর দেওয়া তথ্যগুলির বিচার বিবেচনা না করে আমার বক্তব্যের সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি (যেমন, লক্ষ্মী সুব্রাহ্মানিয়াম, Review, Indian Economic and Social History Review, July, 1997; রজতকান্ত রায়, গ্রন্থলোক, দেশ পত্রিকা, ১২ জুলাই ১৯৯৭। রজত রায়ের উত্তরে আমার বক্তব্য, দেশ পত্রিকা, নভেম্বর ১৯৯৭।)
৪. সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত
বহুদিন ধরে ঐতিহাসিকরা বলার চেষ্টা করছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার যে-সংঘর্ষ (১৭৫৬-৫৭) বাধে, তার জন্য মূলত দায়ী নবাব সিরাজদ্দৌল্লাই। এই মতের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল (S. C. Hill, 1905), যদিও এই বক্তব্যই বেশ চাতুর্যের সঙ্গে এবং খুব সূক্ষ্মভাবে (সোজাসুজি নয়) অধুনাতম গ্রন্থেও পরিবেশিত হয়েছে। উক্ত সংঘর্ষের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে হিল বলছেন, সিরাজদ্দৌল্লার ‘আত্মম্ভরিতা’ (vanity) এবং ‘অর্থলিপ্সাই’ (avarice) এ সংঘর্ষের মুখ্য কারণ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের যে কতগুলি নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ছিল, হিল সাহেব সেগুলিকে ‘ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য’ নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন।১ নবাব হওয়ার আগে হয়তো সিরাজদ্দৌল্লা কিছুটা দাম্ভিক ছিলেন কিন্তু নবাব হওয়ার পরে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর আচরণে বা সম্পর্কে এমন কোনও ঘটনা বা তথ্য দেখানো মুশকিল যাতে প্রমাণিত হয় যে সিরাজের দাম্ভিকতাই ইংরেজের সঙ্গে তাঁর বিরোধের অন্যতম কারণ। আর খোদ ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকেই সহজে দেখানো যায় যে সিরাজের অর্থলিপ্সা যদি থেকেও থাকে, তা কিন্তু কোনওভাবেই এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী নয়। অন্যদিকে আমাদের কাছে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে দেখানো যাবে যে, যদি কোনও একটি কারণকে এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী করা যায় তবে তা হল কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর রজার ড্রেকের (Roger Drake) কঠিন ও অনমনীয় মনোভাব। হিল কিন্তু এ-সংঘর্ষে ড্রেকের ভূমিকা সম্বন্ধে আশ্চর্যরকমের (সুবিধেজনকও বটে) নীরব!