একেবারে প্রথম দিকে ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল এশিয়া থেকে মশলাপাতি সোজা ইউরোপে রফতানি করা। এই মশলাপাতির প্রধান উৎস ছিল পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের তথাকথিত মশলাদ্বীপগুলি (Spice Islands)—আজকের ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও প্রভৃতি অঞ্চল ও মালাক্কা ইত্যাদি। কোম্পানিগুলি ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে ওই অঞ্চলে মশলা কিনতে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ভাস্কো ডা গামার আগে আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানে, বিশেষ করে, দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচুর রুপোর খনি পাওয়া যায়। সে-সব খনি থেকে ইউরোপে তখন প্রচুর রুপো আসতে থাকে। সে রুপো নিয়ে এসে এশিয়াতে বাণিজ্য করতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির খুব সুবিধে হয়ে গেল। কোম্পানিগুলি মশলাদ্বীপে গিয়ে দেখল সেখানে সোনা-রুপোর চাহিদা তেমন নেই, সবচেয়ে বেশি চাহিদা ভারতীয় মোটা ও সস্তা কাপড়ের। ফলে তারা নজর দিল ভারতের দিকে, সোনা-রুপো দিয়ে ভারত থেকে সস্তা কাপড় কিনে সেগুলো মশলাদ্বীপে নিয়ে গিয়ে তার বিনিময়ে মশলা সংগ্রহ করার জন্য। ভারতে তাদের প্রথম নজরে এল করমণ্ডল বা মাদ্রাজ উপকূল—যেখানে সস্তা ও মোটা কাপড় যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে করমণ্ডলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ ও নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সেখানে বাণিজ্য করা শুধু অসুবিধাজনক ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ল না, অনিশ্চিতও হয়ে দাঁড়াল, কাপড়চোপড়ের দামও অনেক বেড়ে গেল। তাই করমণ্ডলের বাণিজ্য ছাড়তে তারা বাধ্য হল।
তখন কোম্পানিগুলি বাংলার দিকে নজর দিল। তারা আবিষ্কার করল, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করার অনেক সুবিধে। বাংলায় অপর্যাপ্ত সস্তা ও মোটা কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব। এ-সব কাপড় অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক সস্তাই শুধু নয়, এগুলির মান অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক উৎকৃষ্টও। দ্বিতীয়ত, বাংলা কাঁচা রেশমের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই রেশম যেমন উন্নত মানের, তেমনি দামেও অনেক সস্তা। ইউরোপে এই রেশমের চাহিদা হবে প্রচুর, কারণ পারস্য বা চিনদেশের রেশমের তুলনায় এর দাম অনেক কম, মানও বেশ উন্নত। এতদিন পারস্য ও চিনদেশের রেশমই ইউরোপের চাহিদা মেটাত, সে-জায়গায় বাংলার রেশম খুবই ভাল বিকল্প হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলার সোরার প্রচুর চাহিদা হবে ইউরোপে কারণ সেখানে তখন গৃহযুদ্ধ ও এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। সোরা গোলাবারুদ তৈরি করার সবচেয়ে বড় উপাদান। বাংলার সোরা যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট তা শুধু নয়, দামেও বেশ সস্তা। তা ছাড়া, জাহাজের তলদেশে লোহার পরিবর্তে সোরা রেখে জাহাজকে সমুদ্রবাহী করা যাবে, কারণ তলদেশে ভারী পদার্থ রেখেই সমুদ্রে জাহাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে হত। লোহা দিয়ে সে-কাজ করলে সেটা একেবারেই লাভজনক হত না, অথচ তার পরিবর্তে সোরা দিয়ে এ-কাজ করলে, সেই সোরা ইউরোপে বিক্রি করে বেশ ভাল মুনাফাই করা যাবে। তাই সব দিক থেকে ইউরোপে সোরা রফতানি খুব লাভজনক। এ-সব কারণে কোম্পানিগুলি বাংলায় বাণিজ্য করতে আগ্রহী হল এবং বিপুল উৎসাহে বাণিজ্য শুরু করে দিল।৩
তবে ১৬৭০-এর আগে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ৭০-এর দশকে হঠাৎ ইউরোপে বাংলার কাঁচা রেশমের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়, যার ফলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৬৮০-এর দশকে যখন ইউরোপে এবং ইংল্যান্ডে বাংলার কাপড়ের চাহিদা হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে যায়, তখন থেকেই আসলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। ইউরোপে বাংলার কাপড়ের হঠাৎ যে বিরাট চাহিদা দেখা যায় তার অন্যতম কারণ ওইসব দেশের মানুষের মধ্যে রুচির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর আগে ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে বাংলা তথা ভারতের সস্তা ও মিহি কাপড় পরার চল বিশেষ ছিল না। এ-সব কাপড় গরিব ও খুব সাধারণ লোকদের পরিধেয় ছিল, যারা দামি লিনেন বা ওখানকার অন্য ভাল কাপড় কিনতে পারত না। ভারতীয়/বাংলার কাপড় সস্তা বলে শবদেহের আচ্ছাদন হিসেবেই বিশেষ করে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ৮০-র দশকে হঠাৎ বাংলা তথা ভারতীয় কাপড় ব্যবহার করা সমগ্র ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু অভিজাত লর্ড বা লেডিরা নয়—ঠাকুর, চাকর, ঝি, সবাই ভারতীয়/বাংলার কাপড় না পরলে ইজ্জত থাকছে না বলে ভাবতে শুরু করল। ফলে ইউরোগে ও ইংল্যান্ডে ভারতীয়, বিশেষ করে, বাংলার কাপড়ের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল এবং কোম্পানিগুলিও তাই প্রচুর পরিমাণে বাংলার কাপড় ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে রফতানি করতে শুরু করল।৪ এইভাবে ১৬৮০-এর দশক থেকে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা বজায় থাকে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাই কোম্পানিগুলির বাণিজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা থেকে এই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অবশ্য মুখ্য অংশ নেয় ডাচ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফরাসি কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে ডুপ্লের (Dupleix) অধীনে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। পলাশি বিপ্লবের পরে অবশ্য চিত্রটা সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে এনে ধীরে ধীরে অন্যান্য ইউরোপীয় এবং এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাংলার বাণিজ্যজগৎ থেকে হঠিয়ে দেয় এবং সবটাই নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলে।৫