আলিবর্দির মৃত্যুর পরে সিরাজদ্দৌল্লা রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর ব্যবহার ও আচার আচরণ কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রথমে, তিনি নবাব হয়েই যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হলেন, সেগুলির তিনি কীভাবে সম্মুখীন হলেন? বিশেষত তাঁর দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও মসনদের দাবিদার ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তিনি কীভাবে করলেন? তাঁর সুবিদিত বেপরোয়া স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি কি অদূরদর্শিতা বা অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন? এ সবেরই উত্তর না, এ ধরনের কিছুই তিনি করেননি। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সমঝোতা করতে তিনি এমন কূটনৈতিক চাল দিয়েছিলেন যে, তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎ-জঙ্গী-র লেখক ইউসুফ আলি খান তার তারিফ না করে পারেননি৷ উক্ত লেখক এই মর্মে লিখেছেন যে, বহুলোক যারা আগে ঘসেটি বেগমকে সমর্থন করত, তারা সিরাজের ‘আপোসমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে’ বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।৩৫ শওকত জঙ্গ অবশ্য আরও অনেক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজের তখত্ বজায় রাখতে সিরাজ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হন ও তাঁকে পর্যুদস্ত করেন।
কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের (William Watts) ভাষা প্রয়োগ করে বলা যায় যে সিরাজ ছিলেন ‘ঐশ্বৰ্য্য ও শক্তির গর্বে মত্ত’ এক যুবক। কিন্তু তাঁর পনেরো মাস রাজত্বকালে তাঁর অপরিণত বুদ্ধি, পাগলামি বা নির্দয় ব্যবহারের কোনও নজির নেই। কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তাঁর আচরণ ও তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কে প্রথমে তিনি অস্ত্রধারণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে কূটনৈতিক চালের আশ্রয় নেন। পরে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হলে কূটনীতির সঙ্গে কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির বিরুদ্ধে অভিযান করে শক্তি প্রদর্শন করেন। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন ও তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই তাদের সঙ্গে ব্যবহারে বা সম্পর্কে সিরাজ কখনও বদমেজাজ বা চরম নিষ্ঠুরতা দেখাননি। তবে নবাব হিসেবে তিনি ইউরোপীয় সমেত সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে তিনিই ‘মনিব’ এবং কারও ঔদ্ধত্য তিনি সহ্য করবেন না। ওয়াটস বলছেন, নবাব হিসেবে তাঁর প্রত্যাশা ও দাবি যে, সবাই তাঁর আজ্ঞা বা আদেশ যথারীতি পালন করবে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যে তরুণের বিরুদ্ধে ‘উগ্রমেজাজ ও চরম নিষ্ঠুরতার’ অভিযোগ প্রায় সব বিবরণেই দেখা যায়, কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব হিসেবে তিনি ইংরেজদের প্রতি ব্যবহারে ‘বদান্যতা ও মানবিকতার’ পরিচয় দিয়েছিলেন।৩৬ ইংরেজদের সম্পূর্ণ অসহায় পেয়েও কোনও লুঠতরাজ, হত্যা বা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় কিন্তু সিরাজ নেননি।
লিউক স্ক্র্যাফ্টনের মতো ব্যক্তির কাছ থেকেও এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নবাব হওয়ার পরে সিরাজচরিত্রে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। যদিও স্ক্র্যাফ্টন প্রথমে সিরাজকে ‘অতিরিক্ত পানাসক্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন, পরে অবশ্য তিনি নিজেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংযোজন করেন যে, আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় কোরাণ ছুঁয়ে সিরাজ শপথ করেন যে তিনি ‘জীবনে আর কোনওদিন মদ্যস্পর্শ করবেন না’ এবং সেই শপথ তিনি ‘অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।’৩৭ এটা খুবই অর্থবহ কারণ যে-যুবক অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল সে যে এত সহজে দীর্ঘদিনের বদ-অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারল এবং মৃত্যুপথযাত্রী মাতামহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজীবন রক্ষা করেছে, তার পক্ষে ইচ্ছে করলে নিজের স্বভাবচরিত্র সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। এই কারণে মনে হয় নবাব হওয়ার আগে সিরাজের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।
এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার, যেটা আমরা আগেও বলার চেষ্টা করেছি, যে সিরাজচরিত্রের (নবাব হওয়ার আগে বা পরে) দোষগুণ বিচার করা মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য, এ-বিষয়ে যে-সব ঐতিহাসিক তথ্য ও সূত্রের ওপর নির্ভর করা হয়, সেগুলির পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা, তাদের স্ববিরোধ ও উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি দৃষ্টিগোচরে আনা এবং সেগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করা। আমাদের প্রচেষ্টা, যে তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখানো হয়, এবং ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত, মুর্শিদাবাদ দরবারের শক্তিশালী গোষ্ঠীর মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিরূপতা এবং শেষ পর্যন্ত পলাশির পরিণতি (ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য মূলত সিরাজকেই দায়ী করা হয়), সে-সব তথ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা কতদূর তা যাচাই করা। যে বক্তব্যের ওপর আমরা জোর দিয়েছি, তা হল নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্র যতই দাম্ভিক, অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল হোক না কেন, নবাবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। দয়ামায়াহীন উগ্র স্বভাব বা পাগলামির কোনও লক্ষণ কিন্তু তখনকার আচরণে পাওয়া যায় না। নবাব হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধীদল এমনকী ইউরোপীয়দের প্রতিও কোনও নির্মম অত্যাচার করেননি বা উগ্র মেজাজ দেখাননি। অবশ্য নবাবি ক্ষমতা পেয়ে কিছুটা উদ্ধত ও মেজাজি ভাব তাঁর মধ্যে দেখা গেছে। অর্থাৎ সিরাজের দোষত্রুটি ছিল ঠিকই। প্রধান দোষ, দৃঢ় সিদ্ধান্তের অভাব, অস্থিরমতি ও সংকট মুহূর্তে দিশাহারা অবস্থা। তবে মনে রাখা দরকার, তখনও তিনি মাত্র ২৩-২৪ বছরের যুবক। যথেষ্ট পরিণতবুদ্ধি নন এবং তার ওপর ক্ষমতা ও পদগর্বে গরীয়ান। বিভিন্ন শত্রুকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটাই তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। তারা যাতে একজোট হয়ে তাঁর বিরোধিতা করতে না পারে সেই অত্যাবশ্যক সাবধানতা তিনি অবলম্বন করেননি। এই অক্ষমতা ও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত স্থির সংকল্পের অভাব তাঁর পতন ডেকে এনেছিল।