- বইয়ের নামঃ পলাশির অজানা কাহিনী
- লেখকের নামঃসুশীল চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০. ভূমিকা / ঋণ স্বীকার
পলাশির অজানা কাহিনী – সুশীল চৌধুরী
.
আমার মা স্বৰ্গতা ইন্দুবালা চৌধুরীর স্মৃতির উদ্দেশে
.
ঋণ স্বীকার
আমার স্ত্রী, মহাশ্বেতা, এ বই লেখার ব্যাপারে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে এ-বই লেখা সম্ভব হত না, যেমন হত না আমার অন্য বইগুলি লেখাও। বহরমপুরের ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ এ বইয়ের জন্য কয়েকটি ছবি দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য বই থেকে ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে বাধিত করেছেন। কলকাতার ছবি দুটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর সৌজন্যে। আনন্দ পাবলিশার্স অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বইটি প্রকাশনার ব্যবস্থা করায় আমি আনন্দিত।
.
ভূমিকা
পলাশির যুদ্ধ ও বিপ্লবের প্রায় আড়াইশো বছর পরেও এই ঘটনা বাঙালির জাতীয় জীবনকে আজও আলোড়িত করে, অথচ এর ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির এখনও অভাব দেখা যায়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনুকরণ করে পলাশির ব্যাখ্যা করে চলেছি, নিতান্ত একতরফাভাবেই। তাই এতদিন পরেও পলাশির যুদ্ধ ও বিপ্লবকে বৃহত্তর ইতিহাসের পটভূমিকায় সংস্থাপিত করে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারায় জাতীয় ইতিহাস নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই তাগিদ থেকেই এই গ্রন্থের অবতারণা। বস্তুতপক্ষে, পলাশি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশিতে ইংরেজদের বাংলা বিজয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলা থেকেই এবং বাংলার অর্থভাণ্ডার দিয়েই ইংরেজরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা। সেজন্য ইংরেজরা কেন এবং কীভাবে বাংলা জয় করল তার সম্যক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, এস. সি. হিল (১৯০৫) থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল (১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭), রজতকান্ত রায় (১৯৯৪) প্রমুখের গ্রন্থেও সিরাজদ্দৌল্লা, পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে কতগুলি বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দেখা যায়। সাধারণভাবে এ-বক্তব্যগুলি হল, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনও ভুমিকা ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত এবং নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি ‘আকস্মিক’ ঘটনামাত্র, এর পেছনে তাদের কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা (মার্শালের ভাষায় ‘no calculated plottings’) ছিল না। মুর্শিদাবাদের দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তারা মাঠে নেমে পড়ে এবং নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় সামিল হয়।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তিনি শেষপর্যন্ত বাংলার মসনদ পর্যন্ত হারালেন, তার জন্য মূলত দায়ী তিনিই। আবার পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে যে, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠীকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। ইদানীং এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘সংকট’ও (বিশেষ করে কে. এন. চৌধুরী, ১৯৭৮; মার্শাল, ১৯৮০; ৮৭) দেখা যাচ্ছিল এবং এই উভয় ‘সংকট’ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই যেন ইংরেজরা ‘অনিচ্ছাসত্ত্বেও’ বাংলা জয় করে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক আবার ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে প্রাক্-পলাশি বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় যত্নবান। এঁদের বক্তব্য, পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম নবাবের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
আমরা কিন্তু এখানে বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছি যে ওপরের প্রায় সব বক্তব্যগুলিই অসার, মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। গত দু’দশকের বেশি ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (India office Records, British Library, London) রক্ষিত ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও ‘প্রাইভেট পেপারস’ এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভসে (Algemeen Rijksarchief, The Hague) সংরক্ষিত ডাচ কোম্পানির দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে (যেগুলো পলাশির প্রেক্ষিতে আগে কেউই দেখেননি বা ব্যবহার করেননি) যে-সব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি এবং তার পাশাপাশি আগের জানা তথ্য ও সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে আমরা ওপরের বক্তব্যগুলি খণ্ডন করেছি। আমরা দেখিয়েছি, প্রাক্-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক, কোনওরকমের ‘সংকট’ই ছিল না। তাই বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকটে’র ফলেই পলাশি বিপ্লব হয়েছিল, এ অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এটাও দেখিয়েছি, মধ্য অষ্টাদশ শতকে, পলাশির প্রাক্কালে, বাঙালি সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মোটেই দ্বিধাবিভক্ত ছিল না। সুতরাং এই দ্বিধাবিভক্ত সমাজই পলাশির অন্যতম কারণ, এ বক্তব্যও অচল।