সে যাই হোক, একাধারে বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার পদে মুর্শিদকুলির নিযুক্তি মুর্শিদাবাদের ইতিহাসেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ঢাকার বদলে মুর্শিদাবাদই এখন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদ হয়ে উঠল বাংলার প্রাণকেন্দ্র, রাজতন্ত্র ও শাসনযন্ত্রের সব ক্রিয়াকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এ অবস্থা চলল সিরাজদ্দৌলা পর্যন্ত, অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধ অবধি। তারপরই বাংলায় স্বাধীন নবাবি আমলের পরিসমাপ্তি। তারপরের নবাবরা মূলত ইংরেজদের ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। ইংরেজরাও ধীরে ধীরে কলকাতাকে সব ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল করে তুলল। ফলে মুর্শিদাবাদ স্বাধীন নবাবি আমলের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
মুর্শিদকুলিই বাংলায় নিজামত বা নবাবির প্রতিষ্ঠাতা। দিল্লির মুঘল বাদশাহদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল, তিনি শুধু নিয়মিত বাংলার রাজস্ব দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতেন। দিল্লিতে তখন ডামাডোল, একের পর একজন দিল্লির মসনদ দখল করছেন, মুর্শিদকুলি কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। দিল্লিতে যিনিই বাদশাহ হচ্ছেন, মুর্শিদকুলি তাঁকেই রাজস্ব পাঠাচ্ছেন, কোনওরকমের ভেদাভেদ না করে। তিনি জানেন, বাংলার রাজস্ব ছাড়া দিল্লির কোনও বাদশাহেরই চলবে না। তাই তাঁরা কেউই মুর্শিদকুলিকে ঘাঁটাতে যাবেন না, বাংলায় তিনি যা করতে চাইবেন, তাই করতে পারবেন। এভাবেই তিনি বাংলায় নিজামত এবং স্বাধীন নবাবি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পর বাংলার অন্য নবাবরাও তাঁর নীতি অনুসরণ করে বাংলা থেকে নিয়মিত রাজস্ব পাঠিয়েছেন, দিল্লিও বাংলা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। নবাব আলিবর্দি খানের রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর অবধি নিয়মিত এ রাজস্ব পাঠানো হয়েছিল। মনে হয় ১৭৪০-এর দশকের প্রথম কয়েক বছরের পর, সম্ভবত মারাঠা আক্রমণের জন্য, এ রাজস্ব পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।৬
১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করার পর থেকেই একদিকে যেমন সেখানে লোক সমাগম বেড়ে যায় তেমনই অন্যদিকে শাসনকার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন দফতরের জন্য নির্মাণকার্যও শুরু হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমিদারদের আমলারা, দেওয়ানি কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সব কানুনগো ও অন্যান্য কর্মচারীরা সবাই ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসে। তা ছাড়া বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার-মহাজনও, যাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান জগৎশেঠ পরিবার, নতুন সুযোগের সন্ধানে ঢাকা থেকে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।৭ এ ছাড়াও, মুর্শিদকুলির রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের ফলে যে নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী শ্রেণির আবির্ভাব হয় মুর্শিদাবাদ তাদেরও প্রধান আস্তানা হয়ে ওঠে।৮ শুধু তাই নয়, মুর্শিদাবাদ প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় ও পরে রাজধানী হওয়ার ফলে তার গুরুত্ব এতই বেড়ে যায় যে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে, কাশিমবাজারে, তাদের কুঠিগুলিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে, যদিও অবশ্য তাদের কাছে কাশিমবাজার কুঠিগুলির প্রয়োজনীয়তা কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহের জন্য।
দেওয়ানির পরে যখন মুর্শিদকুলিকে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত করা হল, তখন মুর্শিদাবাদই বাংলার রাজধানীতে পরিণত হল। ফলে সেখানে শুধু রাজকর্মচারী নয়, ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার থেকে শুরু করে নানারকম অসংখ্য লোকের আনাগোনাও শুরু হয়ে গেল এবং এদের মধ্যে অনেকেই নতুন রাজধানীতে তাদের আস্তানা পাতল। এভাবে মুর্শিদাবাদ বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম শহর হয়ে উঠল। শুধু ভারতীয় বা এশীয় বণিকরা নয়, অনেক বিদেশি বণিকরাও মুর্শিদাবাদে ঠাঁই করে নিল। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আর্মানিরা। মুর্শিদাবাদের পার্শ্ববর্তী সৈয়দাবাদে তারা নিজেদের একটি বসতি স্থাপন করে সেখানে একটি গির্জাও প্রতিষ্ঠা করল।৯ ফরাসিরাও এখানে একটি কুঠি তৈরি করে।১০ তা ছাড়া মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজার বাংলার বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানে এশিয়া ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ী, সওদাগর, ব্যাঙ্কার-মহাজনদের শুধু নয়, প্রায় সব প্রধান ইউরোপীয় কোম্পানিরও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।১১ এসব কারণে মুর্শিদাবাদের গুরুত্বও অনেক বেড়ে যায়।
মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি কার্যালয় নিয়ে আসার পরে স্বাভাবিক কারণেই মুর্শিদকুলি বিভিন্ন দফতরের জন্য নির্মাণকার্য শুরু করে দেন। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিম জানাচ্ছেন, দুঘরিয়ার ঊষর ও নির্জন প্রান্তরে মুর্শিদকুলি একটা প্রাসাদ, দেওয়ানখানা (Board of Revenue), খালসা খাজাঞ্চিখানা (Court of Exchequer) প্রভৃতি তৈরি করেন।১২ তা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের সুবিধের জন্য তিনি একটি সরাইখানা তৈরি করেন, তার মধ্যে একটি মসজিদও। তিনি যখন বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন এবং মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়, তখন সেখানকার নির্মাণকার্য স্বভাবতই অনেক বেড়ে যায়। তিনি মুর্শিদাবাদে একটি টাঁকশালও স্থাপন করেন এবং সেখানে যে মুদ্রা তৈরি হত তাতে লেখা থাকত ‘মুর্শিদাবাদ টাঁকশালে তৈরি’।১৩ তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদের পূর্ব প্রান্তে তাঁর খাস তালুকে তিনি একটি খাজাঞ্চিখানা, একটি কাটরা ও মসজিদ এবং বিরাট একটি জলাশয় নির্মাণ করেন। ওই মসজিদের সিঁড়ির তলায় তিনি নিজের সমাধিক্ষেত্রও বানিয়ে নেন। মৃত্যুর পর তাঁকে ঐখানে সমাধিস্থ করা হয়।১৪ এটি ‘জাফর খানের কাটরা’ নামে পরিচিত।