২২. তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ২৯; রিয়াজ, পৃ. ২৫০; Abdul Karim, Murshid Quli, p. 22.
২৩. রিয়াজ, পৃ. ২৮; Mohsin, Murshidabad, p. 4.
২৪. ঐ, পৃ. ৪।
২৫. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৩৩৮-৩৯।
২৬. Mohsin, Murshidabad, p. 4, f.n. 5.
২৭. রিয়াজ, পৃ. ২৫২-৫৩; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৩৩৮।
২৮. History of Bengal, vol. II, p. 404; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 22-23.
২৯. History of Bengal, vol. II, p. 399.
৩০. ঐ, পৃ. ৪০৪।
৩১. Abdul Karim, Murshid Quli, p. 23 and f.n. 2 same page.
০৩. মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ – নবাবি আমল
নবাবি আমলেই মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ, এ কথা সর্বতোভাবে স্বীকার্য। নবাবি আমল বলতে অবশ্য আমরা স্বাধীন নবাবি আমলের কথাই বলছি অর্থাৎ মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত, তার মানে পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত। তারপর মুর্শিদাবাদে কিছুদিন নবাব অধিষ্ঠিত ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে নবাবরা ইংরেজদের হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। ফলে মুর্শিদাবাদের গৌরবময় দিনের অবসান সিরাজদ্দৌলার পর থেকেই। পলাশির পর ইংরেজরা পর্যায়ক্রমে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয় এবং মুর্শিদাবাদের পরিবর্তে কলকাতা হয়ে ওঠে বাংলার প্রাণকেন্দ্র। ফলে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদকুলি খান
মুর্শিদকুলি শুধু মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তনই করেননি, এর উন্নতিকল্পে তাঁর অবদান অনেকখানি। অবশ্য এখানে বলা প্রয়োজন, তখনকার বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও মুর্শিদকুলির সহায়ক হয়েছিল যার ফলে তিনি মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি যে মুর্শিদকুলি একই সঙ্গে মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের বিশেষ বিশ্বাসভাজন ও প্রীতিভাজন হয়ে উঠেছিলেন যার ফলে স্বয়ং সম্রাটের পৌত্র ও বাংলার সুবাদার শাহজাদা আজিম-উস-শানকে উপেক্ষা করেই তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, ঔরংজেব যখন আজিম-উস-শানের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে (মুর্শিদকুলির প্রতি বিরূপতা ও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য) তাঁকে বাংলা ছেড়ে পাটনা চলে যাবার নির্দেশ দিলেন, তখন শাহজাদা আজিম তাঁর পুত্র ফারুখশিয়রকে বাংলায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে পাটনা চলে গেলেন। কিন্তু সম্রাট ঔরংজেব ফারুখশিয়রকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন মুর্শিদকুলির পরামর্শমতো রাজকার্য চালান।১ ফলে কার্যত মুর্শিদকুলিই বাংলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদও বাংলায় প্রাদেশিক সরকারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদেরও গুরুত্বও অনেক বেড়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদ শহরের বিস্তৃতি ও প্রতিপত্তি সমান তালে বৃদ্ধি পেতে লাগল।
বস্তুতপক্ষে ১৭০৭ সালে সম্রাট ঔরংজেবের মৃত্যু পর্যন্ত মুর্শিদকুলিই ছিলেন বাংলার সর্বেসর্বা। ঔরংজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট হলেন প্রথম বাহাদুর শাহ। তিনি পুত্র আজিম-উস-শানকে আবার বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিন্ত আজিম দিল্লিতে তাঁর পিতার কাছেই থাকতে লাগলেন এবং তাঁর পুত্র ফারুখশিয়রকে নায়েব সুবাদার করে বাংলার শাসনভার তাঁর ওপরই ন্যস্ত করলেন। প্রথম বাহাদুর শাহের রাজত্বের প্রথমদিকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মুর্শিদকুলিকে বাংলার ‘ডেপুটি গভর্নর’(সুবাদার) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আজিম-উস- শান তাঁর বহুদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু মুর্শিদকুলির ওপর বদলা নেবার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাঁর বৃদ্ধ ও দুর্বল পিতা সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের ওপর তাঁর প্রভাব খাটিয়ে মুর্শিদকুলিকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করলেন। মুর্শিদকুলিকে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান করে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফলে পুরো দু’বছর, ১৭০৮ থেকে ১৭০৯, তাঁকে বাংলার বাইরে কাটাতে হল।২
কিন্তু ১৭১০ সালে আবার মুর্শিদকুলিকে বাংলার দেওয়ান করে ফিরিয়ে আনা হল। এর প্রধান কারণ শাহজাদা আজিম-উস-শান বুঝতে পেরেছিলেন যে দিল্লির মসনদের জন্য যে লড়াই আসন্ন, এবং যাতে তিনি নিজে একজন প্রধান অংশগ্রহণকারী হবেন, তাতে যত বেশি সংখ্যক মুঘল মনসবদার ও অমাত্যদের সমর্থন লাভ করতে পারবেন, ততই তাঁর শক্তিবৃদ্ধি হবে। সেজন্য তিনি মুর্শিদকুলির সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলে তাঁকে নিজের দলে আনার চেষ্টা করলেন। এর ফলেই মুর্শিদকুলি বাংলার দেওয়ান পদে পুনরায় নিযুক্ত হতে পারলেন। আর কাগজে কলমে তখনও বাংলার সুবাদার রইলেন আজিম-উস-শান।৩
তারপর দিল্লিতে চলল রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা। সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর (১৭১২) যে গৃহযুদ্ধ শুরু হল, তাতে আজিম-উস-শান নিহত হলেন এবং সম্রাট হলেন জাহান্দার শাহ।৪ তাঁর পরে সম্রাট হলেন ফারুখশিয়র (১৭১৩)। তিনি তাঁর শিশুপুত্র ফরখুন্দা শিয়রকে কাগজে কলমে বাংলার সুবাদার পদে নিযুক্ত করেন এবং মুর্শিদকুলি হলেন বাংলার ডেপুটি সুবাদার। শেষ পর্যন্ত সম্রাট ফারুখশিয়র ১৭১৬/১৭ সালে মুর্শিদকুলিকে জাফরখান নাসিরি উপাধি দিয়ে বাংলার সুবাদার পদে অভিষিক্ত করেন। ১৭২৭ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মুর্শিদকুলি একাদিক্রমে বাংলার সুবাদার ও দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এভাবে তিনি ১০ বছরের বেশি বাংলার সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেরে শাসন করে গেছেন। এটা সাধারণ মুঘল শাসনব্যবস্থার যে রীতিনীতি ছিল তার সম্পূর্ণ এবং একমাত্র ব্যতিক্রম। একমাত্র মুর্শিদকুলিই সুবাদার ও দেওয়ান এ দুটি পদের অধিকারী হতে পেরেছিলেন।৪ স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে মুর্শিদকুলি ১৭১৭ সালে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন কিন্তু আব্দুল করিম তাঁর গবেষণায় দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে সালটা আসলে ১৭১৬, ১৭১৭ নয়। মনে হয় আব্দুল করিমের বক্তব্যই সঠিক।৫