সংস্কৃতির দিক থেকেও নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ খুবই উন্নত ছিল। বহু জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ পাশাপাশি বাস করত এখানে। ফলে পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হত। মুর্শিদাবাদ হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিয়া, সুন্নি, আর্মানি ও ইউরোপীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। তার ফলে মুর্শিদাবাদে একটি উদার ও মিশ্র সংস্কৃতির (composite culture) আবির্ভাব হয়। এই সময় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বজায় ছিল, কোথাও কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। শিয়া, সুন্নিরাও পাশাপাশি শান্তিতে বাস করত। মুর্শিদাবাদের নবাবরা মুসলমান হলেও রাজকার্যে হিন্দুদেরই ছিল প্রাধান্য। এতে নবাবদের উদার মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই নবাবরা হিন্দু উৎসব হোলি এবং দেওয়ালি সাড়ম্বরে পালন করতেন। হিন্দুদের মুসলমানদের দরগায় সিন্নি দেওয়া বা মুসলমানদের হিন্দু মন্দিরে পুজো দেওয়া প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুত অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এই মিলনপ্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো ‘দেবতা’র জন্ম— যে ‘দেবতা’ হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নতুন নতুন প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ, উদ্যানবাটিকা প্রভৃতি নির্মাণ করা নবাবদের প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। একদিকে এঁদের মানসিকতা ও সৌন্দর্যপ্রীতি, অন্যদিকে কোষাগারে প্রচুর ধনসম্পদ নতুন নতুন স্থাপত্য নির্মাণের সহায়ক হয়েছিল। মুর্শিদকুলির তৈরি কাটরা মসজিদ মুর্শিদাবাদের অন্যতম আকর্ষণ। মোটামুটি এই সময় থেকেই মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যশিল্পে মুঘল শৈলীর সঙ্গে স্থানীয় শৈলী ও শিল্পরীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। শৌখিন ও বিলাসপ্রিয় নবাব সুজাউদ্দিনের মুর্শিদকুলির প্রাসাদ ‘চেহেল সুতুন’ ছোট বলে পছন্দ হয়নি। তাই তিনি নিজের পছন্দমতো প্রাসাদ, ইমারত, উদ্যানবাটিক নির্মাণ করেন। তাঁর তৈরি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি—ফর্হাবাগ বা সুখকানন। আলিবর্দি খানের জামাতা ও ঘসেটি বেগমের স্বামী, নওয়াজিস মহম্মদ, মোতিঝিলের বিখ্যাত প্রাসাদ তৈরি করেন। ওদিকে সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার আগেই হীরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ নির্মাণ করে সেখানে বাস করতে থাকেন। ইমামবারাও তাঁর তৈরি। নবাবরা আবার তাঁদের সমাধিস্থলও তৈরি করে রাখতেন। আলিবর্দি, সিরাজদ্দৌল্লা, লুৎফুন্নেসা সবার সমাধিই খোশবাগে। মীরজাফর থাকতেন জাফরাগঞ্জের প্রাসাদে। এখানেই তাঁর, মীরণ ও তাঁদের বংশধরদের সমাধি। দুঃখের বিষয়, মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যকর্মগুলির বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত, খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
পলাশির পর থেকেই মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব কমতে থাকে। সিরাজদ্দৌল্লার পর মীরজাফর নতুন নবাব হলেও ইংরেজদের হাতের পুতুলমাত্র। ১৭৬০ সালে মীরকাশিম নবাব হয়ে মুঙ্গেরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ১৭৬৩-তে মীরজাফর আবার নবাব হন। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দেওয়ানি পেল। ১৭৬৬ সালে ক্লাইভ দেওয়ান হয়ে মুর্শিদাবাদে পুণ্যাহ করলেন। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ইংরেজদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য দেওয়ানি ও খালসার সব বিভাগগুলি কলকাতা নিয়ে গেলেন। ফলে মুর্শিদাবাদ থেকে বহু কর্মচারী কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হল। রাজধানী হিসেবে মুর্শিদাবাদের যেটুকু গুরুত্ব ছিল, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট (Regulating Act) পাশ হওয়ার পর কলকাতা ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের সদর দফতর হওয়ায় তাও নষ্ট হয়ে গেল। মুর্শিদাবাদের টাঁকশাল ১৭৯৯ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে বাংলার রাজধানী থেকে মুর্শিদাবাদ শুধুমাত্র একটি জেলাশহরে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে মধ্য-অষ্টাদশ শতকে যে মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যা ছিল আনুমানিক দশ লক্ষ, তা ওই শতকের শেষদিকে অনেকটাই কমে যায়। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষও অবশ্য তার একটি অন্যতম কারণ।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
ORIGINAL SOURCES (মূল সূত্র)
A. MANUSCRIPT SOURCES (পাণ্ডুলিপি)
1. India Office Records, British Library, London
Bengal Public Consultations
Bengal Letters Received
Bengal Secret and Military Consultations
Coast and Bay Abstracts
Despatch Books
European Manuscripts
Factory Records
Home Miscellaneous Series
Mayor Court’s Records, Calcutta
Original Correspondence
Orme Manuscripts
2. ALGEMEEN RIJKSARCHIEF, THE HAGUE, NETHERLANDS
Verenigde Oostindische Compagnie (VOC)
Overgekomen brieven en papiers and Inkomend briefbook, 1720-57 (Select Volumes)
Hoge Rgering van Batavia, 246 (Taillefert’s ‘Memorie’, 17 Nov. 1763)
3. Stadsarchief Antwerpen, Antwerp, Belgium
General Indische Compagnie (The Ostend Company), 5768
B. PRINTED SOURCES (মুদ্রিত আকরগ্রন্থ)
1. PERSIAN WORKS (ফারসি গ্রন্থ)
Gholam Hossein Khan, Seir Mutaqherin, vol. II, trans. Haji Mustafa, Second Reprint, Lahore, 1975.