আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার প্রভাব যে মুর্শিদাবাদের রাজনীতি ও শাসনপ্রক্রিয়ায় বেশ মঙ্গলদায়ক ও ইতিবাচক হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি যে শুধু নিজের জীবন ও সম্মান বিপন্ন করে যুদ্ধক্ষেত্রেও স্বামী আলিবর্দির পাশে থেকেছেন তা নয়, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্যও পরিচালনা করতেন। হতাশা ও প্রয়োজনের সময় তিনি স্বামীকে সাহস দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু তাঁর দুই কন্যা—ঘসেটি ও আমিনা বেগম—ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের। ঘসেটি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, চক্রী ও শ্লথ চরিত্রের। নিজে মসনদ দখল করার জন্য তিনি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করেছিলেন। সঙ্গে দোসর তাঁর গুপ্ত প্রণয়ী ও তাঁর মৃত স্বামী নওয়াজিস মহম্মদের বিশ্বস্ত সহকারি হোসেন কুলি খান। আবার তাঁর ছোট বোন আমিনা বেগমের সঙ্গে যখন হোসেন কুলি অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন, তখন ঘসেটি আমিনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ভাগ্যের পরিহাস, মীরণের নির্দেশে দু’জনকেই গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। এই দু’জনের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সিরাজ-পত্নী লুৎফুন্নেসা। পলাশির পরে শত্রুদের হাত থেকে পলায়মান স্বামীকে তিনি একা ছাড়েননি, সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়ে শিশুকন্যার হাত ধরে তিনি স্বামীর অনুগামিনী হয়েছেন। পরে আমৃত্যু স্বামীর সমাধির পরিচর্যা করেছিলেন। অন্যদিকে মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম ছিলেন মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে সবচেয়ে ধুরন্ধর। স্বামীর মৃত্যুর পরও বহুদিন ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো ইংরেজদের সঙ্গে ভাব করে তিনি বকলমে মুর্শিদাবাদের নবাবি চালিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ পলাশি। পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে এতদিনের যে বক্তব্য—পলাশির পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না’, এটা একটা প্রায় ‘আকস্মিক ঘটনা’, ইংরেজরা প্রায় ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বাংলা বিজয় করতে বাধ্য হয়’, বাংলার ‘অভ্যন্তরীণ সংকটই’ ইংরেজদের ডেকে আনে, ইত্যাদি— মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছাড়া পলাশির ষড়যন্ত্র বা বিপ্লব কোনওভাবেই সম্ভব হত না। তারাই দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি গোষ্ঠীকে একদিকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে কাকুতি-মিনতি করে তাদের (ইংরেজদের) চতুর ‘পরিকল্পনায়’ সামিল করিয়েছিল। আসলে ওই সময় ইংরেজদের পক্ষে বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল কারণ তখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য, যেটা ১৭৩০-র দশক ও ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রমরমিয়ে চলছিল, এক তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলি থেকে দেশীয়দের সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে ইংরেজ বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে। সেই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার ও তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে বাংলা বিজয় ছাড়া ইংরেজদের আর কোনও পথ খোলা ছিল না।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজে নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদে শুধু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে স্থায়ী আস্তানা করে নেয়। এভাবে বহু জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের সমাবেশের ফলে ওখানে একটি ‘কসমোপলিটন’ সমাজ গড়ে ওঠে। জৈন কবি নিহাল সিংহ সুন্দরভাবে এ সমাজের বর্ণনা দিয়েছেন। সামাজিক স্তরবিন্যাসে এখানে ওপরের তলায় ছিল অভিজাত ও অমাত্যবর্গ, বড় বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন ও শ্রেষ্ঠীরা। মাঝখানে নানারকমের পেশা ও বৃত্তিতে নিযুক্ত এক ধরনের মধ্যবিত্ত ও ছোটখাট ব্যবসায়ী আর তলার দিকে কারিগর, দিনমজুর ইত্যাদি নিম্নবিত্তের মানুষ। অর্থনীতির দিকে থেকে নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে যে শ্রীবৃদ্ধি দেখা গেছে, তা এর আগে অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। এ অঞ্চলের রেশম ও রেশমিবস্ত্রের শিল্প ও বাণিজ্যে নবাবি আমলেই সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছিল। মারাঠা আক্রমণের ফলে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতি খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে অভিমত তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অর্থনীতিতে মারাঠা আক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল তবে তা সাময়িক এবং কোনও কোনও অঞ্চলেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিল, তার কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। মারাঠা আক্রমণের বছরগুলোতেও এশীয় ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে যে বিশাল পরিমাণ কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র রফতানি করেছে তাই তার প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে এতদিনের যে বক্তব্য— ইউরোপীয়রাই সবচেয়ে বেশি পণ্য (কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সমেত) রফতানি করত এবং ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি টাকাপয়সা, সোনা-রুপো আমদানি করত— তা যথার্থ নয়। নবাবি আমলে এশীয়/ভারতীয় বণিকরাই সবচেয়ে বড় রফতানিকারক ছিল, ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি টাকাপয়সা, সোনা-রুপো আনত, ইউরোপীয়রা নয়।