নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের শ্রীবৃদ্ধিতে শ্ৰেষ্ঠী-মহাজন-ব্যাঙ্কার-সওদাগরদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। মুর্শিদাবাদ একদিকে সুবে বাংলার রাজধানী, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র। ফলে শুধু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও ধর্মের ব্যবসায়ী-সওদাগর-মহাজনরা এখানে এসে জমায়েত হত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিন বণিকরাজা—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও আর্মানি খোজা ওয়াজিদ। এঁদের বণিকরাজা বলা হয় এই কারণে যে এঁরা সওদাগর-ব্যাঙ্কার হলেও এঁদের জীবনযাত্রা ও ধরনধারণ ছিল রাজাদের মতো। এঁদের মধ্যে জগৎশেঠদের স্থায়ী আস্তানা ছিল মুর্শিদাবাদে, বাকিদের নয়। কিন্তু যেহেতু এঁরা তিনজনই মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং যেহেতু এঁদের রমরমা মুর্শিদাবাদের নবাব ও তাঁর দরবারের আনুকূল্যেই, এঁদের বেশির ভাগ সময়ই কাটত মুর্শিদাবাদে। তাই মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই বণিকরাজাদের কথা এসে পড়বেই।
বাংলায় জগৎশেঠদের আদিপুরুষ মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শদাতা ছিলেন। মুর্শিদকুলি যখন ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে মানিকচাঁদও ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। তারপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নবাবের দাক্ষিণ্যে জগৎশেঠরা উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যান। মানিকচাঁদের উত্তরাধিকারী ফতেচাঁদ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় জগৎশেঠ (সারা দুনিয়ার ব্যাঙ্কার) উপাধি পান। সিরাজদ্দৌল্লার আগে পর্যন্ত সব নবাবদের সঙ্গেই জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আস্তে আস্তে বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচ্ছত্র অধিকার প্রায় কুক্ষিগত করে নেয়। নবাবি আমলে রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেবার অধিকারও ছিল তাঁদের। এ ছাড়া বাট্টার হার নির্ধারণ করা থেকে ঋণের জন্য সুদের হার নির্ণয় করা পর্যন্ত সবকিছুই তাঁদের করায়ত্ত ছিল। শুধু বাংলা বা মুর্শিদাবাদ নয়, সমগ্র উত্তর ভারতে টাকার বাজারে তাঁদের এমনই প্রতিপত্তি ছিল যে ইংরেজ কোম্পানির অনুরোধে তাঁরা একদিনেই সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করে দিয়েছিলেন। তাঁদের এই ফতোয়া সমগ্র উত্তর ভারতেই কার্যকরী হয়েছিল। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম থেকে শুরু করে বাংলায় ডাচ কোম্পানির সব ডাইরেক্টরা লিখেছেন যে জগৎশেঠরা তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার ছিলেন। শেঠদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মতো। সিয়রের লেখক মন্তব্য করেছেন যে তাঁদের ধনসম্পদের কথা বলতে গেলে মনে হবে রূপকথা। আর এক বাঙালি কবি লিখেছেন, গঙ্গা যেমন শতমুখে জলরাশি এনে সমুদ্রে ফেলে তেমনি করে অজস্র ধনরত্ন এসে জমা হয় শেঠদের কোষাগারে।
শেঠদের মতো অন্য দুই বণিকরাজার— উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ— ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার উৎসও ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের আনুকূল্য। উমিচাঁদ ও তাঁর ভাই দীপচাঁদ পাটনার দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে বিহারের সেরা ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার প্রায় কুক্ষিগত করে নেন। তা ছাড়া উমিচাঁদ খাদ্যশস্য ও আফিংয়ের ব্যবসাও একচেটিয়া করার চেষ্টা করেন। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদ বিহারের প্রায় সমগ্র অর্থনীতিকেই নিজের একচেটিয়া করে নেন। বিহারের সোরা ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসা এবং সুবে বাংলায় লবণ-এর ব্যবসায় একচ্ছত্র অধিকার ছিল তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ। তার যে বিরাট প্রভাব ও প্রতিপত্তি, এবং তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের যে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি তার অন্যতম কারণ মুর্শিদাবাদের নবাবদের এবং দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নবাবকে তাঁর প্রয়োজনে ওয়াজিদ সাগ্রহেই অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন, কখনও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। আলিবর্দি তাঁকে ফখর-উৎ-তুজ্জার (বণিকদের গর্ব) উপাধি দিয়েছিলেন।
বণিক রাজাদের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনায় বেগমদের কথাও এসে যায়। এই বেগমদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই নানাভাবে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলেছিলেন, কখনও ভাল, কখনও বা মন্দ। এঁদের কেউ কেউ ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্না, উদারচেতা ও সাহসী। আবার কেউ কেউ চাতুর্য, শঠতা ও খলচরিত্রের মূর্ত প্রতীক। মুর্শিদকন্যা ও সুজাউদ্দিনের বেগম জিন্নতউন্নেসা প্রথম দলের। স্বামী উড়িষ্যার ছোট নবাব সুজাউদ্দিনের নারীসম্ভোগে প্রচণ্ড রকমের আসক্তি দেখে তিনি তাঁকে ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। আবার এই সুজাউদ্দিনই যখন মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর মসনদ দখল করার জন্য সসৈন্যে মুর্শিদাবাদে হাজির হন এবং যখন মুর্শিদকুলির ইচ্ছানুযায়ী নবাব পদে অভিসিক্ত, জিন্নতউন্নেসা ও সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, তখন এই জিন্নতউন্নেসাই পুত্র সরফরাজকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করেন। সুজার শাসনকালে অবশ্য জিন্নতউন্নেসার অভিপ্রায় অনুযায়ীই অনেক সিদ্ধান্ত কার্যকরী হত।