১৭০৭ সালে ঔরংজেবের মৃত্যুর সময়ই মুর্শিদকুলি বাংলার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ঔরংজেবের মৃত্যুর পরও তিনি দিল্লির মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত বাংলার রাজস্ব পাঠাতে ভোলেননি। দিল্লির বাদশাহি মসনদে যিনিই বসুন না কেন, মুর্শিদকুলির নীতিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। মুঘল বাদশাহরাও নিয়মিত অর্থ পেয়ে খুশি, বাংলা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বা সামর্থ্য কোনওটাই তাঁদের ছিল না। ফলে মুর্শিদকুলি নিজের ইচ্ছেমতো বাংলার শাসন চালাতে পেরেছিলেন, দিল্লি থেকে কোনওরকমের হস্তক্ষেপ বা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্ন ওঠেনি। মুঘল শাসনকাঠামোর রীতি ভেঙে ১৭১৬/১৭ সালে মুর্শিদকুলিকে দেওয়ানের সঙ্গে সুবাদারের পদেও নিযুক্ত করা হল। ফলে এতদিন ধরে যে রীতি চলে আসছিল—সব উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও মনসবদারদের দিল্লি থেকেই বাংলায় পাঠান হত— তার এখন সম্পূর্ণ অবসান হল। মুর্শিদকুলি এখন নিজের পছন্দমতো লোককে রাজকার্যে নিযুক্ত করতে লাগলেন— তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় লোকদেরই প্রাধান্য দিলেন। তাতে এতদিন বাইরে থেকে আগত মনসবদার ও অন্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ করত, তা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে বাংলা থেকে আহরিত ধনসম্পদ বাংলাতেই থেকে গেল এবং বাংলার ধনভাণ্ডার বৃদ্ধির সহায়ক হল।
তা ছাড়াও মুর্শিদকুলির শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন মধ্যবিত্ত, ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্রেণি ও বড় বড় জমিদার সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হল। এরা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এদের বেশিরভাগেরই মুখ্য কর্মস্থল মুর্শিদাবাদ হওয়াতে, তার উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে এদের যথেষ্ট অবদান ছিল। নবাব হিসেবে মুর্শিদকুলিও তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিছুটা শাসনবিভাগের প্রয়োজনে, কিছুটা মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তিনি অনেক প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ ও ঘরবাড়ি তৈরি করেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ প্রায় অজ পাড়াগাঁ থেকে প্রাণবন্ত একটি শহরে পরিণত হল। শুধু তাই নয়, নতুন রাজধানীর নবাবি দরবারে নানারকম জাঁকজমকেরও ব্যবস্থা করেন মুর্শিদকুলি। এই দরবারে একদিকে যেমন বড় বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অভিজাতবর্গ অন্যদিকে অনেক বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির প্রতিনিধির, নিত্য আনাগোনা ছিল। নানা ধর্মীয় উৎসবে মুর্শিদকুলি সাধুসন্ত, ফকির, শেখ, সৈয়দ প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের লোকদের আপ্যায়িত করতেন এবং মুর্শিদাবাদকে হাজার হাজার আলোকমালায় সাজিয়ে তুলতেন।
পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিন রাজ্যশাসনের ভার—জগৎশেঠ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও হাজি আহমেদ—এই ত্রয়ীর ওপর ছেড়ে দিলেও নিজে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যায়নে যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন। শৌখিন, বিলাসপ্রিয় এই নবাবের মুর্শিদকুলির নির্মিত প্রাসাদ ও ইমারতগুলি ছোট বলে মোটেই পছন্দ হয়নি। তাই তিনি নতুন নতুন প্রাসাদ, ভবন, উদ্যানবাটিকা নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন থেকে শুরু করে ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ব অধিকর্তা স্যার জন শোর পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন যে সুজাউদ্দিনের সময় বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। এরপর নবাব সরফরাজ মাত্র কিছুদিন রাজত্ব করেছিলেন— আলিবর্দির হাতে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মারাঠা আক্রমণ সত্ত্বেও আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের প্রভূত উন্নতি হয়। মারাঠাদের কাছ থেকে শান্তি কিনে নেবার পর তিনি মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন মুছে দিতে বদ্ধপরিকর হন এবং তাতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন। তার প্রমাণ হিসেবে মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি জানিয়েছেন যে ওই সময় মুর্শিদাবাদ শহর অনেক বিস্তার লাভ করে। আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারের জাঁকজমক ছিল দেখবার মতো। তখন পুণ্যাহের দিনে যে মহোৎসব হত, তা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। সিরাজদ্দৌল্লার পনেরো মাসের রাজত্বেও মুর্শিদাবাদের বৈভব ও জাঁকজমকে কোনওরকমের ঘাটতি ছিল না। আলিবর্দির নবাবি প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও তিনি মনসুরগঞ্জে নিজের পছন্দমতো বিশাল হীরাঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
মুর্শিদাবাদের নবাবদের ধনভাণ্ডারে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ সঞ্চিত ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এ সম্পদ কিন্তু তাঁরা সঞ্চয় করেছিলেন দিল্লিতে প্রত্যেক বছর (১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত) ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাবার পর। পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের কোষাগারে সঞ্চিত ধনরত্ন দেখে হতবাক হয়ে যান। এই ধনাগারে সোনা রুপো মিলে ২ কোটি টাকার মতো সঞ্চিত ছিল। তা ছাড়া বলা হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার হারেমে যে ধনসম্পদ লুকোনো ছিল তার পরিমাণ কম করে ৮ কোটি টাকার মতো। শুধু তাই নয়, মুর্শিদাবাদের অভিজাতবর্গের যা সঞ্চয় ছিল তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আলিবর্দির কন্যা ও ঢাকার ছোট নবাব নওয়াজিস মহম্মদের পত্নী ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লা নাকি ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগরদের সম্পদের পরিমাণও কিংবদন্তি হয়ে আছে। জগৎশেঠদের ব্যবসার মূলধন ছিল ৭ কোটি টাকা এবং ধনসম্পদ ১৪ কোটি টাকার মতো। মুর্শিদাবাদ দেখে ক্লাইভ মন্তব্য করেছিলেন যে শহরটি লন্ডনের মতোই জনবহুল— লন্ডনের সঙ্গে তফাত শুধু এই যে মুর্শিদাবাদে এমন কিছু লোক আছে যারা লন্ডনের যে কোনও বাসিন্দার চাইতে অনেক অনেক বেশি ধনী।