আপনার বক্তব্য আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। দেওয়ান ও ফৌজদার হিসেবে আপনার পুরোপুরি ক্ষমতা— তাতে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। আপনার বিরুদ্ধে কারও কোনও অভিযোগই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার ওপর আমার যে আস্থা এবং বিশ্বাস সে বিষয়ে আপনি সন্দেহ করছেন কেন? কোনও শয়তানের অভিসন্ধিই সফল হবে না। আল্লা আমাদের এইসব শয়তানের হাত থেকে নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন।… আপনার প্রতি আমার আস্থার কথা মনে রাখবেন, আমার নির্দেশগুলি খেয়াল রাখবেন, মনে কোনও শঙ্কা রাখবেন না। আরও বেশি মন দিয়ে রাজস্ব আদায় করে যান।
ঔরংজেব সত্যিই করতলব খাঁর ওপর খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন, বিশেষ করে তাঁর যোগ্যতা ও সততা দেখে ১৭০৪ সালে তিনি তাঁকে লেখেন: ‘একই ব্যক্তি হয়ে আপনি বাংলা ও বিহারের দেওয়ান, ওড়িষ্যার নাজিম ও দেওয়ান। আপনার পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও-সব অঞ্চলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এত কাজ করতে পারতাম না। একমাত্র আল্লার প্রসাদধন্য কোনও ব্যক্তিই এত যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে।’১৮
সে যাই হোক, করতলব খাঁ কিন্তু আজিম-উস-শান সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না। তাঁর ভয় হল শাহজাদা সুযোগ পেলেই আবার তাঁর প্রাণহানির চেষ্টা করতে পারেন। তাই তিনি সুবাদার থেকে দূরে কোথাও তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় সরিয়ে নিতে মনস্থ করলেন। এজন্য তিনি গঙ্গা (ভাগীরথী) তীরবর্তী মখসুদাবাদকে বেছে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তেই তিনি মখসুদাবাদকে দেওয়ানির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বলে সিদ্ধান্ত করেন।১৯ ওটা বাংলার প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে ওখান থেকে বাংলার প্রায় সব অংশের ওপর সুষ্ঠুভাবে নজর রাখা যাবে। সেদিক থেকে ঢাকার চেয়ে মখসুদাবাদের অবস্থান অনেক বেশি উপযোগী। তা ছাড়া, করতলব যেহেতু মখসুদাবাদের ফৌজদারও ছিলেন, সেজন্য তিনি ঢাকার চেয়েও ওখানে অনেক বেশি নিরাপদ ছিলেন। ওখানে তিনিই কর্ণধার, মুঘল অমাত্যদের মধ্যে ঢাকাতে তার স্থান ছিল দ্বিতীয়, সুবাদারের ঠিক পরে। মখসুদাবাদে তিনিই প্রধান। এখানে দেওয়ানি কার্যালয় সরিয়ে নেবার স্বপক্ষে তিনি হয়তো এটাও ভেবেছিলেন যে ওখান থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর নজরদারি করাও অনেকটা সুবিধেজনক হবে। এ সময় কোম্পানিগুলি গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল।২০
স্থানটি নির্বাচন করে সুবাদার শাহজাদা আজিম-উস-শানের অনুমতি না নিয়েই, দেওয়ানি কার্যালয়ের সব আমলা-কর্মচারীদের নিয়ে করতলব খাঁ মখসুদাবাদে চলে এলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে তিনি ঢাকা থেকে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কারদের তাঁর সঙ্গে করে মখসুদাবাদ নিয়ে এলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন বাংলায় জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদও।২১ ওখানে কাছারি ও অন্যান্য যাবতীয় বিভাগের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে তিনি ওখান থেকেই দেওয়ানির কাজকর্ম পরিচালনা করতে শুরু করে দিলেন। এখানে লক্ষ করার বিষয়, তিনি সুবাদারকে না বলে, এমনকী তাঁর অনুমতি না নিয়েই, মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন তাঁর ওপর সম্রাট ঔরংজেবের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। শাহজাদা তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে নালিশ করলেও কোনও ফল হবে না।
করতলব খাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কিছুদিন পরেই ঔরংজেব আজিম-উস-শানকে বাংলা ছেড়ে বিহারে চলে যাবার নির্দেশ দেন। পুত্র ফারুখশিয়রকে ঢাকায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে শাহজাদা আজিম সপরিবারে পাটনায় আশ্রয় নেন এবং সেখানে থাকাই স্থির করেন। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে তিনি নিজের নামানুসারে পাটনার নতুন নামকরণ করেন আজিমাবাদ। অনুমান, তিনি ঢাকা ছেড়ে পাটনা যান ১৭০৩ সালে।২২ এর ফলে ঢাকায় সুবাদারের উপস্থিতি আর থাকল না, মখসুদাবাদই সুবার সব কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠল। এ ভাবে মখসুদাবাদে প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় স্থাপিত হল এবং পরে এটাই সুবার প্রাদেশিক সরকারের কেন্দ্র হয়ে উঠল।
এখানে স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল জাগতে পারে, করতলব খাঁ মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করার আগে জায়গাটা কেমন ছিল? গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস-সলাতিন থেকে জানা যায়, মখসুস খান নামে এক ব্যবসায়ী প্রথম জায়গাটির উন্নতিসাধন করেন। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে একজন মখসুস খানের নাম পাওয়া যায়, যিনি একজন মুঘল অমাত্য হিসেবে ষোড়শ শতকের শেষদিকে বাংলা ও বিহারে রাজকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। মুখসুস খান ওখানে একটি সরাই নির্মাণ করেন এবং স্থানটি তাঁর নামানুসারে মখসুদাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।২৩ ডাচ পর্যটক ভ্যালেন্টাইনের (Valentijn, ১৬৫৮-৬৪) ম্যাপে মখসুদাবাদকে গঙ্গার দুই শাখার মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ হিসেবে দেখানো হয়েছে।২৪ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন যে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবাদ আছে যে সুলতান হোসেন শাহের সময় মুখসূদন দাস নামে এক নানকপন্থী সন্ন্যাসী তাঁকে অসুখ থেকে সুস্থ করে তোলায় তিনি তাঁকে ওই স্থান দান করেন এবং ওই সন্ন্যাসীর নামানুসারে ওই স্থানটির নাম হয় মুখসুদাবাদ বা মখসুদাবাদ।২৫ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে কাশিমবাজারের মতো মখসুদাবাদও কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এবং সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেটা আরও বাড়তে থাকে। ফলে এখানে শাসনবিভাগের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়, যেটার উল্লেখ পাওয়া যায় ইংরেজ কোম্পানির এজেন্ট স্ট্রেনশ্যাম মাস্টার (Streynsham Master) ও উইলিয়াম হেজেসের (William Hedges) লেখায়।২৬