বাংলার দেওয়ানপদে করতলব খাঁর নিযুক্তি তৎকালীন সুবাদার শাহজাদা আজিম-উসশানের মোটেই মনঃপূত হয়নি। এতদিন তিনি নিজেই বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন— দেওয়ানির দেখাশোনাও তিনিই করতেন। এখন হঠাৎ করতলব খাঁ উড়ে এসে জুড়ে বসায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট কিন্তু যেহেতু করতলবকে স্বয়ং সম্রাট ঔরংজেব নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন, শাহজাদা আজিম মুঘল বাদশাহের পৌত্র হওয়া সত্ত্বেও করার কিছু ছিল না। এখানে মনে রাখা দরকার মুঘল শাসনব্যবস্থায় সুবাদার ও দেওয়ান দু’জনেই সম্রাটের দ্বারা নিযুক্ত হতেন এবং স্বাধীনভাবে নিজের নিজের শাসন পরিচালনা করতেন। সুবাদার ছিলেন সাধারণ শাসনব্যবস্থা ও সৈন্যবাহিনীর প্রধান, দেওয়ান ছিলেন রাজস্ববিভাগের দায়িত্বে। তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল রাজস্ব সংগ্রহ। তিনি কিন্তু সুবাদারের অধীন ছিলেন না, সোজা মুঘল সম্রাটের কাছেই ছিল তাঁর দায়বদ্ধতা। এহেন অবস্থায় দেওয়ান করতলব খাঁর আগমনে শাহজাদা আজিম খুবই মুশকিলে পড়ে যান কারণ রাজস্ব বিভাগের ওপর তার আর কোনও কর্তৃত্বই থাকল না। ফলে দিল্লির বাদশাহি মসনদের জন্য আসন্ন গৃহযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য বাংলা থেকে প্রয়োজনীয় অর্থভাণ্ডার সংগ্রহ করার পথে করতলব খাঁ প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠবে— এটা শাহজাদা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তাই প্রথম থেকেই তিনি করতলব খাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন।
করতলব বাংলায় এসেই সোজা রাজধানী জাহাঙ্গিরনগরে (ঢাকা) চলে গেলেন এবং সুবাদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে দেখা করলেন। তারপরই তিনি দেওয়ানি কাজে মনোনিবেশ করলেন। প্রথমেই তিনি রাজস্ব বিভাগের সব কর্মচারীকে তাঁর অধীনে এবং সুবাদার শাহজাদা আজিমের আওতার বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর তিনি রাজস্ব বিভাগে বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন, যাতে রাজস্ব বৃদ্ধি পায় এবং রাজস্বের অপচয় বন্ধ হয়। এ কাজে তিনি খুবই সাফল্য লাভ করেন যার ফলে প্রথম বছরেই তিনি মুঘল সম্রাট ঔরংজেবকে দাক্ষিণাত্যে এক কোটি টাকা পাঠাতে সমর্থ হন।১৩
এতে আজিম-উস-শান আরও ক্ষেপে গেলেন এবং করতলব খাঁকে একেবারে সরিয়ে দেবার জন্য মতলব ভাঁজতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নগদি সৈন্যদের (ভাড়াটে সৈন্য যারা নগদ টাকার বিনিময়ে সৈন্যবাহিনীতে কাজ করে) সর্দার আবদুল ওয়াহিদকে বশ করে করতলব খাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত করেন। নগদি সৈন্যরা বেশ কিছুদিন তাদের বেতন পায়নি বলে ক্ষুব্ধ ছিল। রাজস্ব বিভাগ থেকেই এই বেতন দেওয়া হত। তাই এজন্য করতলব খাঁকেই দায়ী করা হল এবং চক্রান্তে ঠিক করা হল যে মাইনে আদায় করার ভান করে নগদি সৈন্যরা করতলব খাঁকে রাস্তায় ধরবে এবং হইচই লাগিয়ে দেবে। ওই গণ্ডগোলের মধ্যে সুযোগ বুঝে করতলবকে হত্যা করা হবে।১৪
করতলব খাঁ রোজই সকালে সুবাদারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, কিন্তু তিনি খুব সতর্ক থাকতেন, কখনও একা যেতেন না— সব সময় সশস্ত্র হয়ে কিছু বিশ্বাসী ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতেন। একদিন সকালবেলা তিনি যথারীতি সুবাদারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় হঠাৎ আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে নগদি সৈন্যরা করতলবকে ঘিরে ফেলে তাদের বেতন দাবি করতে লাগল এবং প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু করে দিল। করতলব কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, তিনি নগদি সৈন্যদের নিয়ে সোজা সুবাদারের কাছে চলে গেলেন। তিনি জানতেন এ চক্রান্ত সুবাদারেরই। তাই তিনি সোজা গিয়ে সুবাদারকে বললেন: ‘আপনিই আমাকে হত্যা করার জন্য এ চক্রান্ত করেছেন। মনে রাখবেন সম্রাট আলমগির খুব দূরে নন [তিনি সবই জানতে পারবেন]। এ রকম জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকুন, কারণ এতে সম্রাটের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। সাবধান! আমার প্রাণহানি করলে আপনিও প্রাণে বাঁচবেন না।’১৫
শাহজাদা আজিম-উস-শান করতলবের সাহস দেখে ও ঔরংজেবের শাস্তির ভয়ে খুব ঘাবড়ে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একদিকে আবদুল ওয়াহিদ ও তাঁর সৈন্যদের ডেকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন এবং তাদের কৃতকার্যের জন্য শাস্তি প্রদানের ভয় দেখালেন। অন্যদিকে ভালমানুষের মতো এ ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না বলে করতলবের কাছে সাফাই গাইলেন এবং ভবিষ্যতে করতলবের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেন। করতলব ফিরে এসে সব নথিপত্র তলব করলেন এবং নগদি সৈন্যদের সব প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে তাদের বরখাস্ত করে দিলেন। অন্যদিকে ওয়াকিয়ানবিশকে দিয়ে সব ঘটনার বিবরণ বাদশাহের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, নিজেও সমস্ত ঘটনার কথা লিখে সম্রাটকে জানান। সব খবর পেয়ে ঔরংজেব সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদা আজিমকে কড়া ভাষায় লিখে পাঠান: ‘করতলব খাঁ সম্রাটের একজন পদস্থ কর্মচারী। ওর শরীরের বা সম্পত্তির যদি বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়, তা হলে মনে রাখবে আমি তার শোধ তোমার ওপরই তুলব।’১৬
আসলে করতলব খাঁর ওপর ঔরংজেবের ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। যেহেতু একমাত্র করতলবই তাঁকে নিয়মিত অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই তিনি তাঁর ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এসব কারণে সুবাদার আজিম-উস-শান তাঁর পৌত্র হলেও, তিনি করতলবের ওপর আজিমের কোনও আঘাত বা বিদ্বেষ সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। এ সত্যটা করতলব খাঁও উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাই সুবাদার আজিমকে উপেক্ষা করতে কোনওরকমের দ্বিধা বোধ করেননি। বাংলায় আসার অল্প কিছুদিন পরেই, বিশেষ করে তাঁর প্রতি আজিম-উস-শানের বিরূপতা দেখে, করতলব ঔরংজেবকে জানান, যে তিনি বাংলায় আসাতে কিছু লোক খুবই অসন্তুষ্ট এবং তারা নানাভাবে সম্রাটকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার চেষ্টা করছে। সেজন্য তিনি ঔরংজেবকে অনুরোধ জানান তিনি যেন তাঁর জায়গায় অন্য লোক নিয়োগ করেন। বোঝাই যাচ্ছে, এ বিষয়ে সম্রাট কিছু না করলে তিনি পদত্যাগ করতে চান। ঔরংজেব সঙ্গে সঙ্গে লিখে পাঠালেন:১৭