মুঘল সাম্রাজ্যের ও সম্রাটের যখন এই দুরবস্থা তখন একমাত্র ভরসা ছিল সুবে বাংলা। সাম্রাজ্যের চারদিকে যখন অরাজকতা, অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, সম্রাটকে রাজস্ব পাঠাতে চরম অনীহা এবং কার্যত বন্ধ, তখন বাংলাই একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বস্তুতপক্ষে, সপ্তদশ শতক ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সুবা (প্রদেশ) হিসেবে গণ্য হত। বাংলার উর্বর জমি, বিভিন্ন রকমের ও অপর্যাপ্ত কৃষিজ পণ্য এবং সস্তা অথচ উৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব মিলে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অত্যন্ত মূল্যবান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাংলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর বাংলা যেহেতু সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বাংলায় একমাত্র সোনা-রুপো ছাড়া অন্য কিছুর বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে বাংলা থেকে যারা পণ্য রফতানি করত, তাদের সবাইকে— সে ইউরোপীয় বা এশীয় বণিক যেই হোক না কেন— এ সব পণ্য কেনার জন্য বাংলায় সোনা-রুপো বা নগদ টাকা পয়সা নিয়ে আসতে হত।২
বস্তুতপক্ষে, সপ্তদশ শতকে বাংলার প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। সমসাময়িক বিদেশি পর্যটক ও ফারসি ঐতিহাসিকরা এ নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন। রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন সলিম বাংলাকে জিন্নৎ-অল-বিলাদ বা ‘প্রদেশসমূহের মধ্যে স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেছেন।৩ মুঘল সম্রাট ঔরংজেব নাকি বাংলাকে বলতেন ‘জাতীয় স্বর্গ।’৪ সব মুঘল ফরমান, পরওয়ানা বা সরকারি নথিপত্রে বাংলাকে ‘ভারতবর্ষের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করা হত। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law) লিখেছেন ওটাই বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান।৫ বাংলার সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে এবং এখান থেকে ধনরত্ন আহরণ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন দেশ থেকে বহু লোকের সমাগম হত বাংলায়। ধনরত্নের লোভ ছেড়ে তারা সহজে বাংলা থেকে বিদায় নিতে পারত না। ১৬৬০-এর দশকে ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) মন্তব্য করেছেন:৬
… the rich exuberance of the country… has given rise to a proverb… that the kingdom of Bengal has a hundred gates open for entrance, but not a single one for departure.
স্বাভাবিকভাবে, এই বাংলাই ছিল বাদশাহ ঔরংজেবের একমাত্র আশাভরসা— যেখান থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় হবে এবং তা দিয়ে দাক্ষিণাত্যে তাঁর যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেবে। কিন্তু তাঁর সে প্রত্যাশা পুরোপুরি সফল হল না। শাহজাদা মহম্মদ আজিমুদ্দিন তখন বাংলার সুবাদার। তিনি বাংলায় আসেন ১৬৯০ সালে। তিনি ঔরংজেবের তখন জীবিত জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথম বাহাদুর শাহের পুত্র— অর্থাৎ ঔরংজেবের পৌত্র। ইতিহাসে তিনি আজিম-উস-শান নামেই সমধিক পরিচিত। আজিম-উস-শান রাজস্ব আদায়ে তেমন তৎপর ছিলেন না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল— বাংলা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ধন আহরণ করা— যা দিয়ে তিনি ঔরংজেবের আসন্ন মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদ দখল করার লড়াইয়ে যোগ দিতে পারবেন।৭ ফলে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় ও সম্রাটকে দাক্ষিণাত্যে অর্থজোগান দেবার ব্যাপারে আজিম-উস-শানের তেমন উৎসাহ ছিল না। তাই সম্রাট খোঁজ করছিলেন এমন একজন দক্ষ ও বিশ্বাসী ব্যক্তির যিনি বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারবেন এবং তাঁকে দাক্ষিণাত্যে নিয়মিত অর্থ পাঠাবেন। ভাগ্যক্রমে তিনি এমন একজনের সন্ধানও পেয়ে গেলেন, যাঁর তখন নাম ছিল মহম্মদ হাদি।
কে এই মহম্মদ হাদি?
ঔরংজেব যখন মহম্মদ হাদিকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন, তখন তিনি হায়দরাবাদের দেওয়ান ও ইয়েলকোণ্ডালের ফৌজদার। এ কাজে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন ও সম্রাটের নজরে পড়েন। ঔরংজেব মহম্মদ হাদিকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করে তাঁকে করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে ১৭০০ সালের নভেম্বরে বাংলায় পাঠান। করতলব বাংলায় আসেন ওই বছরের ডিসেম্বরে। বাংলার দেওয়ান পদের সঙ্গে তিনি মখসুদাবাদের ফৌজদার পদেও নিযুক্ত হন।৮
এই করতলব খাঁ ওরফে মহম্মদ হাদি জন্মসূত্রে কী ছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন, তিনি জন্মলগ্নে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং খুব সম্ভবত দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ।৯ তবে তিনি যে ব্রাহ্মণ ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ফারসি ইতিহাস মাসির-উল-উমারাতে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন বলে উল্লেখ আছে।১০ খুব অল্প বয়সেই তাঁকে কিনে নেন হাজি শফি ইস্পাহানি নামে এক পারসিক অভিজাত ব্যক্তি। হাজি সাহেব তাঁকে নিজের পুত্রের মতো বড় করে তোলেন এবং তাঁকে মহম্মদ হাদি নাম দেন। হাজি শফি বিভিন্ন সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ছিলেন, যেমন দেওয়ান-ই-তান (তান মানে তলব বা মাইনে), বাংলার দেওয়ান ও দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান ইত্যাদি।১১
হাজি শফি সম্ভবত ১৬৯০ সালে মুঘল রাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে পারস্য দেশে ফিরে যান। মহম্মদ হাদিও তাঁর মনিবের সঙ্গে ওদেশে চলে যান। কিন্তু হাজির মৃত্যুর পর তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং বেরার প্রদেশের দেওয়ান আবদুল্লা খুরাসানির অধীনে কার্যভার গ্রহণ করেন।১২ যেহেতু হাজি শফি এবং আবদুল্লা খুরাসানি দু’জনেই দেওয়ান ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করে মহম্মদ হাদি কিছুদিনের মধ্যেই রাজস্ব ব্যাপারে অত্যন্ত অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং হায়দরাবাদের দেওয়ান হিসেবে যথেষ্ট কৃতকার্য হন। তাই অতি সহজেই তিনি মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের নজরে পড়েন এবং সম্রাট তাঁকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না।