মুর্শিদাবাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির আলোচনা অষ্টম অধ্যায়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজকর্ম উপলক্ষে বহু জাতি, বর্ণ ও ধর্মের লোকরা এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করত। তারপর পরস্পরের পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হত স্বাভাবিকভাবেই। ফলে মুর্শিদাবাদে একটি ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের অর্থনীতিও বেশ উন্নত ছিল। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দিল্লি-আগ্রা থেকে আগত মনসবদার ও অভিজাতবর্গ বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ করত, মুর্শিদকুলির আমল থেকে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলার ধনসম্পদ বাংলাতে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদেই, সঞ্চিত হত। ১৭৪০-র দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত নবাবরা দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠাতেন। তা সত্ত্বেও এঁদের কোষাগারে যে পরিমাণ ধনরত্ন সঞ্চিত হয়েছিল তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মারাঠা আক্রমণে এ সময় বাংলার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা মোটামুটি বেশ ভালই ছিল বলে ফারসি ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন। জৈন কবি নিহাল সিংহও এটা সমর্থন করেছেন।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য—হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনওভাবেই ব্যাহত হয়নি। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কোনও ঘটনা এসময় ঘটেনি। বরং এই দুই ধর্ম-সংস্কৃতির যে সমন্বয় প্রক্রিয়া তা ওই সময়েই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। এ মিলন প্রক্রিয়া থেকেই ‘সত্যপীরের’ মতো নতুন ‘দেবতা’র উদ্ভব, যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। এ সময় হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে বা মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরা মহা আড়ম্বরে হোলি, দেওয়ালি প্রভৃতি হিন্দু উৎসব পালন করতেন, তাতে কোনও প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও এই দুই ধর্মসংস্কৃতির মিলন প্রক্রিয়ার প্রতিফলন একদিকে মুসলমান কবি ফৈজুল্লা ও অন্যদিকে হিন্দু কবি ভারতচন্দ্রের ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তিতে।
নবম অধ্যায়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের বর্ণনা। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। নবাবদের আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য এক নতুন মাত্রা পায়। মুঘল শৈলীর সঙ্গে বাংলার স্থানীয় শৈলীর সংমিশ্রণ হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত সব নবাবেরই প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ, সমাধিভবন, ইত্যাদি নির্মাণ করা প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। একদিকে নবাবদের এই মানসিকতা, অন্যদিকে তাঁদের হাতে অফুরন্ত ধনরত্ন থাকায় মুর্শিদাবাদে একের পর এক নতুন নতুন প্রাসাদ, মসজিদ, উদ্যানবাটিকা প্রভৃতি নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুর্শিদকুলির কাটরা মসজিদ ও খোশবাগের সমাধিক্ষেত্র, সুজাউদ্দিনের ফৰ্হাবাগ, নওয়াজিস মহম্মদের মোতিঝিল প্রাসাদ, সিরাজদ্দৌল্লার হিরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ, ইমামবারা ও মদিনা, মুন্নি বেগমের চৌক মসজিদ ইত্যাদি। পরিতাপের বিষয়, এগুলির মধ্যে বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শেষ অধ্যায়ে উপসংহার— এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার।
০২. মুর্শিদাবাদ নগরীর পত্তন
অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা।
দিল্লির তখ্তে তখন মুঘল সম্রাট ঔরংজেব। কিন্তু ১৬৮০ থেকেই তিনি দাক্ষিণাত্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। কুড়ি বছর ধরে তিনি মূলত দাক্ষিণাত্যেই অবস্থান করছিলেন। রাজধানী দিল্লি থেকে তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে বিস্তৃত সাম্রাজ্যের বহু অংশেই অরাজকতা দেখা দিয়েছে, শান্তিশৃঙ্খলা ও শাসনব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এককালের পরাক্রান্ত সাম্রাজ্যের পতন প্রায় আসন্ন। কেন্দ্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল থেকেই মুঘল সম্রাটের কাছে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠেছে। সম্রাট ঔরংজেবের চরম দুরবস্থা। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে নিদারুণ অর্থকষ্ট ও যুদ্ধের ধকল— সব মিলে বৃদ্ধ সম্রাট শুধু ক্লান্ত নন, প্রায় বিধ্বস্তও।
অবশ্য তাঁর এই দুর্দশার জন্য ঔরংজেব প্রধানত নিজেই দায়ী। বছরের পর বছর দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সৈন্যবলের অপচয়, তার কোনও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অনেকটা জেদের বশেই তিনি এই অর্থহীন ও অন্তহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হয়ে তিনি দাক্ষিণাত্যের দুই স্বাধীন শিয়া রাজ্যের— বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা— অস্তিত্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। এই দুই রাজ্যকে শায়েস্তা করতে তিনি কুড়ি বছর ধরে দাক্ষিণাত্যে পড়ে রইলেন। আর ওদিকে রাজধানী দিল্লির তথা সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। ঔরংজেবের দাক্ষিণাত্য যুদ্ধ যে তাঁর অপরিণামদর্শিতার পরিচায়ক, এ-বিষয়ে প্রায় সব বিশিষ্ট ঐতিহাসিকই সহমত।১