সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন যখন তিনি বুঝলেন যে নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি জানতেন তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক আনুকূল্যের খুবই প্রয়োজন। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল’র বিতাড়নের (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার সিরাজদ্দৌল্লাকে দেওয়া তাঁর পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজ তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং নবাব তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমনই শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে’র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন: ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে [কাশিমবাজারে] লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’৭৪
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহূর্তে পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি কিছুটা আগে-পরে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।৭৫ এটা সঠিক বলে মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন, ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭-তে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ওসব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি।’৭৬ ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-এ।
ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে, জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল। ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা ভাঙতে না পারে।’৭৭ ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।৭৮
উপরোক্ত তিন বণিকরাজা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, মহাজনও ছিল। কারণ এই অঞ্চল ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র। শুধু বাংলা থেকে নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকী ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও বহু এশীয় বণিকরা কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য এই অঞ্চলে আসত। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম ব্যবসায়ী। এরা মহাজনি কারবারেও লিপ্ত ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি এদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা ধার করত। ১৭২৪-র সেপ্টেম্বর মাসে কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ডাচ কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিল কাটমা পরিবারের।৭৯ ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ ডুপ্লের (Dupleix) সময় তারা কাশিমবাজারের কাটমাদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল।৮০
এই কাটমা পরিবার থেকে ইংরেজ কোম্পানি কাশিমবাজারে তাদের ‘ব্রোকার’ বা প্রধান সওদাগর নিয়োগ করত। ১৭৩০ সালে তারা হাতু (Hathu) কাটমাকে এই পদে নিযুক্ত করেছিল। কারণ তিনি ছিলেন ‘a man of unquestionable credit and the properest person for the post of a broker’, এবং ‘a man of considerable estate.’৮১ কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে বিবাদের ফলে ১৭৩৭ সালে তিনি পদচ্যুত হন এবং তার জায়গায় ‘ব্রোকার’ হলেন কাটমা পরিবারেরই অন্যতম সদস্য, বলাই বা বলরাম কাটমা (রেকর্ডসে Bally)। তাঁকে নিয়োগ করার কারণ তাঁর ছিল ব্যবসায়ী হিসেবে বহুদিনের অভিজ্ঞতা এবং তিনি ছিলেন খুব ধনী পরিবারের লোক।৮২ ১৭৪১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন—সে বছর ওই পদটি তুলে দেওয়া হয়।