বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে ১৭৪০-র শেষদিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন তা ডাচ রেকর্ডস থেকে স্পষ্ট। ১৭৫০ সালে বাংলায় ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে ডাচদের উচিত ওয়াজিদের সঙ্গে হৃদ্যতা রেখে চলা কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তিনি খুবই ‘সম্মানিত ব্যক্তি’।৬৭ পঞ্চাশের দশকে যে তিনি নবাবের দরবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি, তা বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষ ইয়ান কারসেবুমের ১৭৫৫-র লেখা থেকে পরিষ্কার। কারসেবুম লিখেছেন:৬৮
While mentioning those persons whose friendship would be very useful to your Honour I cannot neglect Coja Mahmet Wazit, recently honoured with the title of Faqqur Tousjaar meaning supporter of the treasure because he is truly the maintainer of the riches of the rulers. He gives them a lot willingly rather than under compulsion.
বলা বাহুল্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথম কয়েকবছর, পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত, ওয়াজিদ মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন এবং স্বভাবতই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন মুর্শিদাবাদেই। আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হবেন এটা ধরে নিয়ে তিনি ১৭৫২ সাল থেকেই সিরাজের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। ধুরন্ধর এই আর্মানি বণিক খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নবাব ও দরবারের আনুকূল্য অত্যন্ত জরুরি। সে জন্য তিনি প্রথমে নবাব আলিবর্দির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিলেন, পরে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গেও। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকেই ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’-ও মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।৬৯
ওয়াজিদ ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূলভাবাপন্ন ছিলেন। ক্লাইভ তাঁকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।৭০ আসলে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল’-র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।৭১ এর কারণ, তাঁর কাছে তাঁর নিজের ব্যবসার স্বার্থই ছিল সবচেয়ে বড়। তিনি ভাল করেই বুঝেছিলেন যে ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সেরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিংয়ের বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্র-বাণিজ্য, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে এসবের কোনওটাতেও বিশেষ কিছু লাভ হবে না।
ওয়াজিদ যেহেতু মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম, তাই পলাশির ষড়যন্ত্রে তাঁর একটা ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তবে তিনি ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত, এবং অনেকটা ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের সমর্থক। তাই প্রথম দিকে তিনি পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রে তিনি সামিল হন একেবারে শেষ মুহূর্তে। কিন্তু কেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (জানুয়ারি ১৭৫৭) পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য পরামর্শ দেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে ফরাসি চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদ্দৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হতে পারবে না।৭২ এটা থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতকেই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:৭৩
আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব [ওয়াজিদ] ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকম অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছেন…সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে সবসময় আমাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন…শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের খতম করে দেন।