মোট দশটি অধ্যায়ে আমার বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই ‘ভূমিকা’-তে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের পত্তনের ইতিবৃত্ত। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে এবং কেন মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে দেওয়ানি কার্যালয় মখসুদাবাদে নিয়ে আসেন এবং তাঁর নিজের নাম অনুযায়ী নতুন নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। বিভিন্ন তথ্যের সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে ১৭০৪ সালেই যে মুর্শিদাবাদের পত্তন তাও এখানে প্রতিষ্ঠিত। পরের অধ্যায়ে মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন নবাবরা কীভাবে মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন তার সম্যক বিশ্লেষণ। বস্তুতপক্ষে, নবাবি আমলই মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। বহু তথ্যের সমাবেশে এখানে তাই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে বণিকরাজাদের (merchant princes) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার তিন বণিকরাজা— জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ— মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। নবাবদের সঙ্গে এঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নবাবদের আনুকূল্যেই এঁরা বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতির প্রায় সবটাই কুক্ষিগত করে নেন। শুধু তাই নয়, বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতেও এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
পঞ্চম অধ্যায়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। পলাশি বাদ দিয়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না। বিশেষ করে এতদিন পর্যন্ত পলাশির যে ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা দিয়ে এসেছেন— কেন এই ষড়যন্ত্র, কে বা কারা এর মূল নায়ক, এতে ইংরেজদের ভূমিকা কী, ইত্যাদি— তা সত্যি যুক্তিগ্রাহ্য কিনা তা নতুন করে বিচার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ এর মধ্যে অনেক নতুন তথ্য, বিবরণগত শুধু নয় পরিসংখ্যানগতও বটে, আমরা ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে আবিষ্কার করতে পেরেছি যার ভিত্তিতে এতদিনের বক্তব্যগুলি অসার বলে প্রমাণ করা যায়। সংক্ষেপে এ বক্তব্যগুলি হল— পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না, তাদের বাংলা বিজয় নেহাতই ‘আকস্মিক ঘটনা’, প্রায় ‘অনিচ্ছাকৃত’। বাংলার ‘অভ্যন্তরীণ সংকটই’ ইংরেজদের বাংলায় ডেকে আনে, পলাশি ‘ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র’, ইত্যাদি। এখানে আমরা এই সব বক্তব্যগুলি খণ্ডন করে দেখিয়েছি যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছাড়া পলাশি সম্ভব হত না। তারাই একদিকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে প্রায় কাকুতিমিনতি করে নবাবের দরবারের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীকে তাদের ‘বিপ্লবে’র পরিকল্পনায় সামিল করিয়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন, ইংরেজদের পক্ষে বঙ্গবিজয় এত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল কেন এবং যে প্রশ্নের কোনও উত্তর এতদিন কেউ দিতে পারেননি, আমরা তা এখানে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৭৩০-র দশক থেকে ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা চলছিল। এরা এই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত। কিন্তু ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৫০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায়। তার কারণ ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলি থেকে দেশীয় বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও তাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের বেগমদের বৃত্তান্ত। এঁদের চারিত্রিক বৈপরীত্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কেউ কেউ স্বামীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন শুধু নয়, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্যও পরিচালনা করেছেন। স্বামীর বিপদের সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও উচ্চাকাঙক্ষা চরিতার্থ করার জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেননি। জিন্নতউন্নেসা, শরফুন্নেসা, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, লুৎফুন্নেসা, মুন্নি বেগম প্রমুখের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করে তাই এখানে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের শিল্পবাণিজ্যের বিশ্লেষণ। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল বাংলায় কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ভারতবর্ষ ও এশিয়া ছাড়াও ইউরোপে এই দুটি পণ্যের বিরাট চাহিদা ছিল। ফলে নবাবি আমলে এই দুটি পণ্যের উৎপাদন এবং বাণিজ্যের দ্রুত অগ্রগতি হয়। এশীয়/ভারতীয় বণিক এবং ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে এই পণ্য দুটি রফতানি করত। এতদিন ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে এই রফতানি বাণিজ্যে মুখ্য ভূমিকা ছিল ইউরোপীয়দের, তারাই এই দুটি পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি করত। কিন্তু আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে এখানে দেখিয়েছি যে এতে এশীয়/ভারতীয়দের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই দুটি পণ্য রফতানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। বস্তুতপক্ষে, কাঁচা রেশমের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এশীয়/ভারতীয়দের রফতানির পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানি মিলে যে মোট রফতানি তার চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।