সিকটারম্যানের পরবর্তী ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস (Jan Huijghens) ১৭৫০ সালে তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে কোম্পানির পক্ষে হুগলিতে জগৎশেঠের গোমস্তা বৈজনাথের (Baijnath) সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার কারণ তা হলে তিনি তাঁর মনিব জগৎশেঠদের দিয়ে মুর্শিদাবাদ দরবার থেকে তাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধে আদায় করতে পারবেন।২৮ তাঁর উত্তরসূরি ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ১৭৫০ সালে তার ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের দুই উত্তরাধিকারী, জগৎশেঠ মহতাব রাই ও মহারাজা স্বরূপ চাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে ও বিস্তৃত হচ্ছে। কারণ তাঁরা নবাবকে সবসময় নবাবের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। তাই কারসেবুম জোর দিয়েছেন যাতে কোম্পানি জগৎশেঠদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখে।২৯
কারসেবুমের উত্তরসূরি লুই টেইলেফারটও (Louis Taillefert) তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে জগৎশেঠরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার। তিনি জানাচ্ছেন ডাচরা বাংলা থেকে চিঠিপত্রে এতদিন ধরে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের কথা লিখেছে যে হল্যান্ডে কোম্পানির কর্মকর্তাদের সন্দেহ হতে পারে এমন নামের কোনও ব্যক্তি আদৌ ছিল কি না। আসলে বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রে জগৎশেঠদের কুঠিগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। হুগলিতে তাঁদের কুঠির নাম ছিল শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ আনন্দচাঁদজী, ঢাকায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও জগৎশেঠ ফতেচাঁদজী, পাটনায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ দয়ানন্দজী।৩০ আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ ও মহাচাঁদ জগৎশেঠ ফতেচাঁদের তিন ছেলে। ফতেচাঁদ বেঁচে থাকতেই প্রথম জনের মৃত্যু হয়। আমরা আগেই দেখেছি জগৎশেঠ মহতাবচাঁদ ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ ফতেচাঁদের পৌত্র ও তাঁর উত্তরসূরী।৩১ এখানে উল্লেখযোগ্য যে জগৎশেঠদের এমনই প্রতিপত্তি ও প্রভাব ছিল যে বাংলা ও বিহারের সব ব্যাঙ্কার-মহাজন, শরাফ তাঁদের তাঁবে থেকেই নিজেদের কাজকারবার করত। কেউ তার অন্যথা করলে তার রক্ষা ছিল না—জগৎশেঠরা তাকে শেষ করে ছাড়তেন।৩২
ইউরোপে যেমন কিছু কিছু পরিবার রাষ্ট্রের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করতেন, জগৎশেঠরাও তেমনি কার্যত বাংলার নবাবের ব্যাঙ্কার ছিলেন। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এন. কে. সিনহা মন্তব্য করেছেন: ‘The Jagat Seth house was to the Bengal Nawabs what the Fugger of Augsburg were to the Emperor Charles V of Germany and the Medicis of Florence were to the Papacy in the Middle Ages’.৩৩
শেঠদের ধনসম্পদের পরিমাণ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করা খুবই কঠিন। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন খান লিখেছেন:
…their riches were so great that no such bankers were ever seen in Hindustan or Deccan…. nor was there any banker or merchant that could stand comparison with them all over India…. Their wealth was such that there is no mentioning it without seeming to exaggerate and to deal in extravagant fables.৩৪
এক বাঙালি কবি বলেছেন গঙ্গা যেমন শতমুখে জলরাশি এনে সমুদ্রে ফেলে, তেমনি ধনরত্ন এসে জমা হত জগৎশেঠদের কোষাগারে।৩৫ ১৭৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) অনুমান করেন যে শেঠদের ব্যবসার মূলধন ছিল ৭ কোটি টাকার মতো।৩৬ অন্যদিকে এন. কে. সিনহার ধারণা, জগৎশেঠদের সমৃদ্ধির যুগে তাঁরা অন্তত ১৪ কোটি টাকার মালিক ছিলেন।৩৭ লিউক স্ক্র্যাফ্টনের হিসেব অনুযায়ী ১৭৫৭ সালে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মতো।৩৮
সারণি ১
জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়, ১৭৫৭
(টাকায়)
রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেওয়া বাবদ ১০% হারে ১০,৬০,০০০
জমিদারদের কাছ থেকে সুদ বাবদ ২০% হারে ১৩,৫০,০০০
বছরে ৫০ লক্ষ টাকা টাঁকশালে
নতুন মুদ্রায় পরিবর্তন করার জন্য ৭% ৩,৫০,০০০
৪০ লক্ষ টাকার ওপর সুদ, ৩৭-১/২% হারে ১৫,০০,০০০
বাট্টা বা বিনিময়ের সুদ বাবদ, ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা ৭,০০,০০০
মোট ৪৯,৬০,০০০
(সূত্র: ক্লাইভকে লেখা স্ক্র্যাফ্টনের চিঠি, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৫৭)
জগৎশেঠদের কী পরিমাণ টাকা ছিল তার একটা আন্দাজ করা যেতে পারে মারাঠারা যখন ১৭৪২ সালে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে, তখন মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়ি লুঠ করে নগদ ২ কোটি টাকা (সিয়রের লেখক গোলাম হোসেনের মতে, যদিও মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি বলেছেন তিন লক্ষ টাকা) নিয়ে চলে যায়। সিয়রের অনুবাদক হাজি মুস্তাফা লিখেছেন, এই বিশাল পরিমাণ টাকা লুঠ হয়ে গেলে ইউরোপের যে কোনও রাজাই বিচলিত হয়ে পড়তেন কিন্তু জগৎশেঠ ফতেচাঁদের হাবভাবে বিশেষ কোনও তারতম্য হল না, ‘he continued to give govern-ment bills of exchange at sight of full one crore at a time’৩৯
জগৎশেঠদের খ্যাতি এতই ব্যাপক ছিল যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যত বিশিষ্ট ইউরোপীয় কর্মচারী ছিল, তাদের সবাই শেঠদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছে। ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম (Robert Orme) কিছুকাল বাংলায় ছিলেন। তিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিকে লিখেছেন যে সারা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ শরাফ ও ব্যাঙ্কার।৪০ ক্যাপ্টেন ফেন্উইক (Captain Fenwick) নামে এক ইংরেজ স্বাধীন বণিক (Free Merchant), যিনি কলকাতায় থাকতেন, বলেছেন যে জগৎশেঠ মহতাব রাই নবাবের খুবই প্রিয়পাত্র এবং লন্ডনে ব্যাঙ্কারদের কেন্দ্র লম্বার্ড স্ট্রিটের সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও তাঁর মতো ব্যাঙ্কার হবে না।৪১ ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী ও পলাশি চক্রান্তের মূল নায়কদের অন্যতম লিউক স্ক্র্যাফ্টন (Luke Scrafton) জগৎশেঠ সম্বন্ধে ১৭৫৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে ক্লাইভকে লেখেন: ৪২