অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে জগৎশেঠরা একটি প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠে। বাংলার অন্য সব ব্যাঙ্কার, সওদাগর-ব্যবসায়ী, শরাফ প্রভৃতি সব ব্যাপারেই জগৎশেঠদের অনুকরণ করে চলত। মারাঠা আক্রমণের জন্য জগৎশেঠ যখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান, তখন কাশিমবাজারের ইংরেজ কাউন্সিল কলকাতায় লিখেছিল (৭ জুন ১৭৪২) যে যতদিন না জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে আসছেন, ততদিন সেখানকার কোনও সওদাগর, মহাজন বা শরাফ নিজেদের নিরাপদ ভাববে না। তাই নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠকে অনুনয় জানালেন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন কারণ ‘his presence being as necessary to the Nabub as to the merchants’ এবং ‘his conduct being the general guide to all of them’।১৮ ক’দিন পর (১৪ জুন ১৭৪২) কাশিমবাজার থেকে কুঠিয়ালরা জানাল যে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন এবং সে খবর পেয়ে অন্যান্য মহাজন ও ব্যবসায়ীরাও শহরে ফিরে এসেছে।১৯ আবার ফতোচাঁদ যখন পরের বছর (১৭৪৩ সাল) মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কায় মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে গেলেন তখন কাশিমবাজার কাউন্সিল ফোর্ট উইলিয়ামে লিখছে যে ফতেচাদ চলে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদে টাকা ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে—বাজারে টাকার এত অভাব জগৎশেঠের মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাওয়ার জন্য।২০ তারা আবার ২ জুলাই লিখেছে যে ফতেচাঁদ ফিরে এসেছেন, ফলে বাজারে এখন টাকার কোনও অভাব নেই।২১
জগৎশেঠরা অষ্টাদশ শতকের প্রায় প্রথম থেকেই মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। বাংলার নবাব ও তাঁদের শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর জগৎশেঠদের যে বিরাট প্রভাব ছিল তা অভূতপূর্ব—বাংলার ইতিহাসে এমনটি আর কখনও দেখা যায়নি। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পালাবদলে শেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।২২ বাদশাহি দরবারে তাঁদের যে কতটা প্রভাব ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁরা মুঘল দরবার থেকে বাংলার নবাবদের স্বীকৃতি ও অনুমোদন জানিয়ে ফরমান আনিয়ে দিতেন। এভাবে জগৎশেঠ ফতোচাঁদ মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর নবাব সজাউদ্দিনের জন্য দিল্লিতে দরবার করে তাঁর জন্য অনুমোদন জোগাড় করেন। তাই সুজাউদ্দিন ফতোচাঁদের প্রতি মুর্শিদকুলির চেয়েও অনেক বেশি উদার ছিলেন এবং শেঠদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নানা রকমের সুবিধা দিয়েছিলেন। ১৭৩০ সালে কাশিমবাজারে শেঠদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঝামেলা হয়—কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির ভারতীয় গোমস্তাকে নিয়ে। ইংরেজরা তখন নবাবের অন্যতম দুই প্রধান অমাত্য, হাজি আহমেদ ও দেওয়ান আলমচাঁদকে দিয়ে শেঠদের বিরুদ্ধে সুজাউদ্দিনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু’জনেই তাদের পরামর্শ দিলেন, ফতোচাঁদকে নবাব খুবই শ্রদ্ধা এবং সমীহ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোন কথাই নবাব শুনবেন না। তাই শেঠদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নিলেই ইংরেজরা ভাল করবে, কোনও অমাত্যেরই জগৎশেঠের বিরুদ্ধে নবাবকে কোনওভাবেই প্রভাবিত করার সাধ্য নেই।২৩ হাজি আহমেদ কাশিমবাজার কাউন্সিলকে জানান যে ‘Futtichund’s Estate was esteemed as the King’s treasure and the Nabob was resloved to see him satisfied.২৪
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব রাষ্ট্রবিপ্লবেই জগৎশেঠদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ হাত ছিল। তাঁদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদলই সম্ভব ছিল না। সমসাময়িক প্রায় সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও ফারসি ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। পলাশির যড়যন্ত্র ও বিপ্লবে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নেন, যদিও এ চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা ছিল ইংরেজরা। তারা উমিচাঁদের মাধ্যমে প্রথমে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা করে। লতিফ সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে নবাব হওয়ার বাসনা জানিয়েছিল এবং তিনি যে জগৎশেঠদের সমর্থন পাবেন তা জানাতেও ভোলেনি। পরে যখন মীরজাফরকে পাওয়া গেল তখন ইংরেজরা তাড়াতাড়ি ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরকেই নবাব করার ষড়যন্ত্র করল। তার কারণ শুধু এই নয় যে ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাশালী অমাত্য (তিনি নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ), তার চেয়েও বড় কারণ তিনি জগৎশেঠদের অনেক বেশি কাছের লোক।২৫ কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘It is this family [of Jagat Seth] who conducted all his (Alivardi’s) business and it may be said that it had long been the chief cause of all the revolutions in Bengal.:২৬
বাংলায় জগৎশেঠদের যে প্রবল ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল তা দেখে বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষরা সবাই তাদের উত্তরসূরিদের জন্য লেখা ‘মেমোরি’তে (mem- orie—যাতে বাংলার শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সওদাগর-মহাজন সবকিছু সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ ও পরামর্শ থাকত) জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ওপর বিশেষ জোর দিতেন। ১৭৪৪-এ বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান সিকটারম্যান (Sichtermann) তাঁর ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার (‘greatest banker of Hindosthan’ বা ‘voornaamsten wis- selaar van geheel Hindosthan’)। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনি কারবার ভারতবর্ষের সর্বত্র বিস্তৃত। তিনি যদিও ব্যক্তিগতভাবে শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তা হলেও পুরো ব্যাপারটাতেই তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। সে জন্য তাকে সবসময় খুশি রাখা এবং তাঁর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখা খুবই দরকার। এটা করার সবচেয়ে ভাল উপায় তাঁকে নিয়মিত বিরল প্রজাতির ছোট পাখি, ভাল মশলা ও ছোটখাট এবং দুষ্প্রাপ্য জিনিস উপহার দেওয়া।২৭