জগৎশেঠদের প্রভূত আয়ের আরেকটি বড় উৎস ছিল বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময়ের হার বা বাট্টা ধার্য করার অধিকার। বাংলার নবাবদের সঙ্গে শেঠদের এমনই ঘনিষ্ঠতা এবং তাঁদের ওপর ও বাংলার টাকার বাজারে এঁদের এমনই প্রভাব ছিল যে (যার অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁরা নবাবদের প্রয়োজনে বরাবরই অর্থ সাহায্য করে গেছেন) তাঁরা নবাবদের দিয়ে তাদের সুবিধামতো বিনিময়ের হার ধার্য করাতে পারতেন। তখনকার বহু নথিপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।৭ তা ছাড়া এ সময় বাংলায় নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্নরকমের মুদ্রা আসত, বাংলায়ও ছিল নানা রকমের মুদ্রা। বাজারে কিন্তু এসব চলত না। সব রকমের মুদ্রাকেই সিক্কা টাকায় পরিবর্তিত করতে হত—এ জন্য দিতে হত বাট্টা। এ বাট্টার হার ঠিক করত জগৎশেঠরা, তাঁদের লাভের অঙ্ক মাথায় রেখে। ফলে বাট্টা থেকেও তাঁদের প্রচুর লাভ হত। জগৎশেঠরা পুরনো বা অন্য প্রান্ত থেকে আসা সব মুদ্রা টাঁকশালে পাঠিয়ে নতুন চলতি মুদ্রায় (সিক্কা) পরিবর্তিত করতেন আর এই মুদ্রা পরিবর্তন করার জন্য তাঁরা বাট্টা নিতেন। সেটা থেকে তাঁদের আয় হত প্রচুর। লিউক স্ক্র্যাফ্টনের (Luke Scrafton) অনুমান অনুযায়ী (১৭৫৭ সাল) জগৎশেঠরা বছরে ৫৮ লক্ষ টাকার মতো মুদ্রা তৈরি করত এবং এ বাবদ তাদের বার্ষিক আয় হত ৩-১/২ লক্ষ টাকা।৮ এ ছাড়াও দেশি ও বিদেশি মুদ্রা বাংলায় চলতি সিক্কা টাকায় বিনিময় করে দেওয়ার জন্য শেঠদের প্রচুর আয় হত। তাঁরা নবাবের প্রাপ্য রাজস্বও জমা নিতেন। জমিদার ও আমিলরা তাঁদের কাছে ভূমি রাজস্ব জমা দিত। তা ছাড়াও যারা রাজস্ব আদায়ের নিলাম কিনত, শেঠরা তাদের জামিনও হতেন, অবশ্যই লাভের বিনিময়ে।
জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের আরেকটি সোজা রাস্তা ছিল চড়া সুদের মহাজনি ব্যবসা। তারা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে বার্ষিক শতকরা ১২ টাকা হারে টাকা ধার দিতেন। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য এসব কোম্পানিরা ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে আসত ঠিকই। কিন্তু ইউরোপ থেকে জাহাজ আসতে অনেক সময় দেরি হত। আবার এসব রুপো সোজাসুজি টাঁকশালে নিয়ে গিয়ে সেগুলি থেকে মুদ্রা তৈরি করা সম্ভব হত না কারণ টাঁকশাল ছিল জগৎশেঠদের কর্তৃত্বে। বাজারে বা জগৎশেঠদের কাছে এসব রুপো বিক্রি করে নগদ টাকা জোগাড় করতে সময় লাগত অনেক। এদিকে রফতানি পণ্য জোগাড় করতে টাকার খুব প্রয়োজন হত কারণ ঠিক সময় এসব পণ্য সরবরাহ করার জন্য দাদনি বণিকদের আগাম টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করতে না পারলে পরে অনেক বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হত। আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো পাঠালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে কোম্পানিগুলির প্রায় সবসময় নগদ টাকার ঘাটতি হত। সে জন্য বাজার থেকে তারা টাকা ধার করতে বাধ্য হত এবং মূলত তারা জগৎশেঠদের কুঠি থেকেই এই টাকা ধার করত, যদিও তারা কলকাতার দাদনি বণিক বা কাশিমবাজারের কাটমা পরিবারের কাছ থেকেও টাকা ধার করত।৯
জগৎশেঠদের কাছ থেকে সহজে টাকা ধার করা গেলেও শতকরা ১২ টাকা সুদ কোম্পানিরা খুব বেশি বলেই মনে করত এবং কোনও উপায় নেই বলেই এত চড়া সুদ দিতে বাধ্য হত। কোম্পানিগুলির কর্ণধাররা ইউরোপ থেকে বার বার লিখে পাঠাত যে সুদের হার ‘exorbitant’ এবং তাই ‘rank poison to our commerce’। তাই তারা বাংলায় ধার করাটা একেবারেই চাইত না কারণ ‘the interest…eats deep and insensibly’১০। কিন্তু বাংলায় টাকা ধার না করে তাদের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল না। ১৭৩০-র দশক ও ১৭৪০-র দশকের প্রথম দিকে বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ডুপ্লে (Dupleix) জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে ‘greatest of Jews’ এবং ‘our chopping-block’ বলে বর্ণনা করলেও টাকার জন্য তাঁর কাছেই হাত পাততে বাধ্য হতেন বারবার।১১ ১৭১৮ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানি মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠদের কাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার মতো ধার করেছিল।১২ আর ১৭৫৫ থেকে ১৭৫৭, এই তিন বছরে জগৎশেঠদের কাছ থেকে ডাচ কোম্পানি ২৪ লক্ষ টাকা ধার করেছিল।১৩ ১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজদের কাছে চন্দননগরের পতন হল, তখন শেঠদের কাছে ফরাসিদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা।১৪
সুদের হার কমানোর কোনও উপায় নেই দেখে কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের কাছে এ জন্য অনুনয় বিনয় করত। তাতে আগে কোন ফল হয়নি। ১৭৪০ নাগাদ শেঠদের বোধহয় মনটা একটু নরম হল। ১৭৪০-র ১১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতায় জানাল যে কোম্পানি যদি জগৎশেঠদের কাছে সুদের হার কমাবার জন্য আবেদন করে, তা হলে তা হয়তো মঞ্জুর হয়ে যাবে।১৫ সে অনুযায়ী কলকাতা কাউন্সিল সেদিন জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখে। ইংরেজদের প্রার্থনা অনুযায়ী জগৎশেঠরা সুদের হার কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করে দিলেন। ১৭৪০-র ২১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা জগৎশেঠের কুঠি থেকে শতকরা ৯ টাকা হারে ৬০,০০০ টাকা ধার করল।১৬ তখন থেকে ইউরোপীয়রা কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ ও জগৎশেঠদের অন্যান্য কুঠি থেকে ওই হারে টাকা ধার করতে লাগল। ১৭৪২ সালের ২৯ মার্চ একদিনে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতায় জগৎশেঠদের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা ধার করে।১৭ ইংরেজদের মতো ডাচ, ফরাসি ও অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের বিভিন্ন কুঠি থেকে প্রয়োজন মতো ঋণ নিত, একই সুদের হারে। জগৎশেঠরা যে একদিনের মধ্যেই সুদের হার কমিয়ে দিতে পারল তা থেকে বাংলা তথা উত্তর ভারতের টাকার বাজারে তাঁদের একাধিপত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।