বস্তুতপক্ষে প্রায়-সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস থেকে জানা যায় যে মারাঠাদের বছরে ১২ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তি কিনে নেবার পর আলিবর্দি বাংলা থেকে মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন মুছে দেবার প্রতি খুবই যত্নবান হয়ে পড়েন। জনৈক ফারসি ঐতিহাসিকের মন্তব্য, আলিবর্দি এ কাজ করেছেন ‘with judgement and alacrity and to the repose and security of his subjects, and never after-wards deviated in the smallest degree from those principles’.৩৫
সিরাজদ্দৌল্লার পনেরো মাসের স্বল্প রাজত্বেও মুর্শিদাবাদে জাঁকজমক ও বৈভবের কোনও ঘাটতি ছিল না। নবাবদের প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের জন্য মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এ প্রাসাদ হীরাঝিলের প্রাসাদ নামে পরিচিত হয়। আলিবর্দির সময়কার মতো তাঁর সময়েও মুর্শিদাবাদ দরবারে এবং রাজপ্রাসাদে মহাসমারোহে হোলি ও অন্যান্য উৎসব পালিত হত। তাঁর কাছে হোলি উৎসবের এমনই আকর্ষণ ছিল যে ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) করেই তিনি তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ এসে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে হোলিতে মেতে ওঠেন।৩৬
মুর্শিদাবাদের নবাব ও বণিকরাজাদের (merchant princes) সঞ্চিত ধনসম্পদ প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। মুর্শিদকুলির সময় থেকে আলিবর্দির রাজত্বের প্রথম দিক অর্থাৎ ১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত দিল্লিতে মুঘল বাদশাহের কাছে রাজস্ব বাবদ বছরে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পাঠিয়েও নবাবের কোষাগারে প্রচুর অর্থ সঞ্চিত হত। শুধু নবাব নন, তাঁর আত্মীয় পরিজন ও অমাত্যরাও বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিল। মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী আলিবর্দি-কন্যা ও ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদের পত্নী ঘসেটি বেগমের মোতিঝিল প্রাসাদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে বিতাড়িত করার পর সেখান থেকে হিরে জহরত বাদ দিয়েই নগদ ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এক কোটি টাকা মূল্যের সোনা-রুপোর নানা বাসনও মোতিঝিল থেকে সিরাজ কবজা করেছিলেন।৩৭ এতে অত্যুক্তি থাকলেও অনেকটাই সত্য আছে বলে মনে হয়।
পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগারে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিল যে ওখানে শুধুমাত্র সোনা-রুপো মিলে ২ কোটি টাকা সঞ্চিত ছিল। তা ছাড়াও, তারিখ-ই-মনসুরীর লেখকের মতে, নবাবের হারেমে লুকোনো যে ধনসম্পদ ছিল, সোনা, রুপো, হিরে, জহরত মিলে তার মূল্য কম করে ৮ কোটি টাকা।৩৮ মুর্শিদাবাদের বণিকরাজা জগৎশেঠদের ব্যবসার মূলধনই ছিল আনুমানিক ৭ কোটি (William Bolts)৩৯ থেকে ১৪ কোটি টাকার (N. K. Sinha)৪০ মতো আর তাদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকা।৪১ পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ দেখে প্রায় হতবাক। তিনি লিখেছেন:৪২
The city of Murshidabad is as extensive, populous and rich, as the city of London, with this difference that there are individuals in the first possessing infinitely greater property than any of the last city.
একটি অনুমান অনুযায়ী ১৭৬০-এর দশকে লন্ডনের জনসংখ্যা ছিল ৭৫০,০০০-এর মতো।৪৩ ক্লাইভের বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তা হলে তখন মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যাও ওরকমই ছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৭৭২ সালে লন্ডনে একটি পার্লামেন্টারি কমিটিতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ক্লাইভ বলেছিলেন:৪৪
Consider the situation in which the victory at Plassey had placed me! A great prince was dependent on my pleasure; an opulent city lay at my mercy; its richest bankers bid against each other for my smiles; I walked through vaults which were thrown open to me alone, piled on either hand with gold and jewels! Mr. Chairman, at this moment I stand astonished at my moderation.
এ থেকে স্পষ্ট যে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ নবাবদের কোষাগারে সঞ্চিত ধনসম্পদ দেখে একেবারে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. আহকম-ই-আলমগিরি, পৃ, ১০৬ক, Abdul Karim, Murshid Quali and His Times-এ উদ্ধৃত, পৃ. ২৫।
২. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, Vol. II, p. 405; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 28-29.
৩. Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 30-31; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, Vol. II, pp. 405-406.
৪. মাসির-উল-উমারা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৭৫২; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৩৯ক, Abdul Karim, Murshid Quli-তে উদ্ধৃত, পৃ. ৫৪; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, p. 406.
৫. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p.407; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 54-55.
৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 11, 18.
৭. রিয়াজ, পৃ. ২৮; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ২৯ক, Abdul Karim, Murshid Quli, p. 21-এ উদ্ধৃত।
৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 17-18; K. M. Mohsin, Murshidabad, p. 6.
৯. S. Chaudhury and M. Morineau, ed., Merchants, Companies and Trade, p. 75. P. C. Majumdar, Musnud, p. 233