আলিবর্দি খান
আলিবর্দির শাসনকালে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে যায়। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত মারাঠারা প্রায় প্রত্যেক বছরই বাংলায় লুঠতরাজ চালায়। তাই আলিবর্দি মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করতে তাঁর রাজত্বের অনেকটা সময়ই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া, এ সময় তাঁকে বিহারে আফগান বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হতে হয়। ফলে তাঁর সময় মুর্শিদাবাদ দরবারের জাঁকজমক তেমন চোখে পড়ে না। মারাঠা আক্রমণের ঢেউ মুর্শিদাবাদেও আছড়ে পড়ে। যেহেতু মারাঠাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল টাকাকড়ি ও ধনসম্পত্তি সংগ্রহ করা এবং যেহেতু রাজধানী মুর্শিদাবাদে নবাব ও তাঁর ধনী অমাত্যরা ছাড়াও বহু বড় বড় ধনী ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ীদের আবাস, তাই মারাঠাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুর্শিদাবাদ। ফলে এ সময় মুর্শিদাবাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ব্যাহত হয়, কারণ মারাঠাদের লুঠতরাজের ভয়ে বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন-ব্যবসায়ী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যেত এবং এ কারণে মুর্শিদাবাদে নগদ টাকা ও ধার জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। দু’-একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।
১৭৪২ সালের ৭ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতায় জানাচ্ছে যে মারাঠা আক্রমণের ভয়ে জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে গেছেন, তাই কোনও শরাফ বা মহাজনই মুর্শিদাবাদে থাকা নিরাপদ মনে করছে না। একমাত্র জগৎশেঠরা ফিরে এলে তারা নিশ্চিন্ত বোধ করবে। ফলে মুর্শিদাবাদের বাজারে নগদ টাকার যথেষ্ট অভাব দেখা দিয়েছে, ধার পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।২৫ ১৪ জুন কাশিমবাজার থেকে কুঠিয়ালরা জানাচ্ছে, জগৎশেঠ ফিরে এসেছেন, তা দেখে অন্য ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারও, তাই বাজারে টাকার আর কোনও অভাব নেই।২৬ আবার ১৭৪৩ সালে মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কায় জগৎশেঠরা যখন মুর্শিদাবাদ থেকে পালালেন, তখন ওই বছর জুন মাসে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি থেকে জানাচ্ছে যে ‘এখানে কোনও ধার পাওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়েছে কারণ জগৎশেঠরা শহর ত্যাগ করার ফলে বাজারে নগদ টাকার নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে।’২৭ আবার ২ জুলাই তারা লিখছে, ‘জগৎশেঠ ফতেচাঁদ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন এবং কাশিমবাজারে এখন টাকার প্রাচুর্য, ধার পাওয়াও অনেক সহজ।’২৮ ১৭৪২ সালে মীর হাবিবের প্ররোচনায় মারাঠারা মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে লুঠতরাজ চালায়, জগৎশেঠের বাড়ি থেকে তারা মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়াও নগদ ২ কোটি টাকা লুঠ করে নিয়ে যায় (মুজাফফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী ৩ লক্ষ)।২৯
তবে মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের অর্থনীতি ও শিল্পবাণিজ্যে এক বিরাট বিপর্যয় দেখা দেয় বলে অনেক ঐতিহাসিকের যে অভিমত, তা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত।৩০ মারাঠা আক্রমণ ও লুঠতরাজ কিছুটা বিপর্যয় ঘটিয়েছিল সন্দেহ নেই, তবে সেটা সাময়িক এবং কোনও কোনও অঞ্চলেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিল। মারাঠারা বাংলা ও মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়— বর্ষা শুরু হবার আগেই তারা বাংলা থেকে ফিরে যেত এবং বর্ষা শেষ হবার পর আবার ফিরে আসত। ফলে বাংলার কৃষক কারিগররা মারাঠারা চলে যাবার পর তাড়াতাড়ি তাদের কাজকর্ম শুরু করে দিত আবার মারাঠারা ফিরে আসার আগে ফসল তুলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেত। তা ছাড়া মারাঠারা মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট পথ ধরেই আক্রমণ করতে আসত এবং সে পথের দু’ধারেই শুধু লুঠতরাজ চালাত।৩১ ফলে মারাঠা আক্রমণ মুর্শিদাবাদ তথা বাংলায় দীর্ঘস্থায়ী কোনও বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি।৩২
১৭৫১ সালে মারাঠাদের সঙ্গে আলিবর্দির চুক্তি হয়ে যাবার পর বাংলা তথা মুর্শিদাবাদে মারাঠা আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আলিবর্দি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলেন এবং দরবারের জাঁকজমকের দিকে নজর দিলেন। এ সময়কার একটি পুণ্যাহের বিবরণ দিয়েছেন তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি। সেদিন চারশোর বেশি ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে জমিদার, অমাত্য, রাজকর্মচারী সবাই ছিল, আলিবর্দি তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী খেলাত বা সম্মান পোশাক প্রদান করেন। তারপর সবাইকে ভুরিভোজে অ্যাপ্যায়িত করা হয়। ওইদিন নবাব তাঁর প্রাসাদে সোনা দিয়ে মোড়া খুঁটির ওপর লাগানো, সোনার সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা সামিয়ানার তলায় স্বর্ণখচিত সিংহাসনে বসে জমিদারদের কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব গ্রহণ করেন।৩৩
মারাঠা আক্রমণ সত্ত্বেও আলিবর্দির সময় যে মুর্শিদাবাদের যথেষ্ট উন্নতি ও বিস্তার হয়েছিল, তার প্রমাণ মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। করম আলি লিখেছেন:৩৪
The city of Bengal [i.e. Murshidabad] in his reign extended over 12 kos [24 miles] in length and 7 kos [14 miles] in breadth; in addition to this, many rich men had built pleasure-houses outside the city. Twelve persons were entitled to play the naubat morning and evening. Many kinds of people, high and low, and all classes of artisans and men of all skill and letters were assembled in this city.