Murshed Kuli Khan employed none but Bengally Hindoos in the collection of revenues, because they are most easily compelled by punishment to discover their malpractices, and nothing is to be apprehended from their pusillanimity.
বলা বাহুল্য, মুর্শিদাবাদে সদর দেওয়ানি কার্যালয় অবস্থিত হওয়ার ফলে উক্ত কর্মচারীদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা উচ্চপদস্থ, তাদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদেই বসবাস করতে শুরু করে। তাতে মনে হয় মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যায় সাম্প্রদায়িক অনুপাতে অনেকটা ভারসাম্য দেখা যায়। রিয়াজের লেখক বলছেন এ সময় মুর্শিদাবাদের জনসাধারণ নবাবদের কল্যাণে দিল্লি তথা উত্তর ভারতের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা ও কথাবার্তা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেদের চালচলন, কথাবার্তা ও ব্যবহারে দিল্লি ও উত্তর ভারতের লোকদের মতো অনেকটা পরিশীলিত হয়ে ওঠে, যেটা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না।২০
সুজাউদ্দিন
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর (১৭২৭) পর তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খান বাংলার মসনদে বসেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ পিতা সুজাউদ্দিন খান, যিনি তখন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর বা ছোট নবাব ছিলেন, মুর্শিদকুলির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মসনদের লোভে মুর্শিদাবাদের দিকে ছুটে আসেন এবং মুর্শিদকুলির প্রাসাদ চেহেল সুতুনে (‘palace of forty pillars’—চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদ— মুর্শিদকুলির তৈরি) নিজেকে বাংলার সুবাদার বা নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন। সরফরাজ কিন্তু এটা মোটেই মেনে নিতে চাননি এবং সুজাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁর চরিত্রের যতই দোষ থাক, তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। তাঁর মা, সুজাউদ্দিনের পত্নী, জিন্নতউন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও গুণবতী মহিলা। তাই স্বামী সুজাউদ্দিনের উচ্ছৃঙ্খল চরিত্র ও নারী সম্ভোগে চরম আসক্তি দেখে তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বামীকে ছেড়ে তাঁর পিতার কাছে চলে আসেন। কিন্তু সরফরাজ যখন তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইলেন, তখন তাঁর দিদিমা, মুর্শিদপত্নী নাসিরা বানু বেগম, ও মা জিন্নতউন্নেসা তাঁকে তা থেকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন যে সুজাউদ্দিন বৃদ্ধ হয়েছেন, বেশিদিন রাজত্ব করতে পারবেন না। তাই কিছুদিনের মধ্যে সরফরাজ নবাব হতে পারবেন— সুতরাং শুধু শুধু রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন নেই। সরফরাজ দিদিমা ও মায়ের কথা মেনে নিয়ে, পিতা সুজাউদ্দিনকে নবাব/সুবাদার হিসেবে স্বীকার করে নিলেন।২১
মসনদে বসার কিছুদিনের মধ্যেই সুজাউদ্দিন শুধু ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিলেন না, সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ দরবারকে নতুন করে সাজিয়ে জাঁকজমক পূর্ণ করে তুলতে লেগে গেলেন। বয়স হয়ে গেলেও তিনি জীবনের আনন্দসম্ভোগ ছেড়ে দিতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। বরং নবাব হওয়ার পর ক্ষমতা ও অর্থের অধিকারী হয়ে তাতে আরও ডুবে গেলেন। তাঁর আনুষঙ্গিক হিসেবে তিনি মুর্শিদাবাদকে ঢেলে সাজাতে চাইলেন। মুর্শিদকুলির তৈরি প্রাসাদ ও অন্যান্য ইমারত ছোট ছোট বলে তাঁর একেবারে পছন্দ ছিল না। তাই তিনি মুর্শিদকুলির প্রাসাদ ভেঙে একটি প্রশস্ত প্রান্তরে বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তা ছাড়াও তিনি একটি অস্ত্রাগার, একটি অত্যুচ্চ তোরণ, একটি দেওয়ানখানা (revenue court), চল্লিশটি স্তম্ভের ওপর চেহেল-সুতুন নামে একটি প্রাসাদ (palace of forty pillars), একটি ব্যক্তিগত দফতর (private office– খিলওয়াত খানা), একটি জুলুসখানা (reception hall) ও একটি খালিসা কাছারি (court of exchequer— ফরমানবাড়ি) নির্মাণ করেন। শুধু তাই নয়, মুর্শিদকুলির সময়কার রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী নাজির আহমেদকে ফাঁসিতে ঝোলাবার পর মুর্শিদাবাদের অদূরে ভাগীরথী তীরে তিনি যে মসজিদ ও উদ্যান নির্মাণ শুরু করেছিলেন, সুজাউদ্দিন সেটা সম্পূর্ণ করেন। সেখানেও তিনি প্রাসাদ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন এবং তাঁর নাম দেন ফরাহবাগ বা ফর্হাবাগ। সেখানে তিনি সারা বছর পিকনিক ও নানারকমের আনন্দ উৎসব করতেন। আর বছরে একবার তাঁর দরবারের উচ্চপদস্থ ও শিক্ষিত কর্মচারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করতেন।২২
সরফরাজ
নবাব সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর (১৭৩৯) সরফরাজ নবাব হলেন। যদিও সমসাময়িক কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেছেন যে তিনি তাঁর পিতার মতোই নারীসম্ভোগ ও বিলাসব্যসনে লিপ্ত ছিলেন,২৩ তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি খান কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা লিখছেন। ইউসুফ আলির ভাষ্য অনুযায়ী সরফরাজের ভোগবিলাসের প্রতি কোনও আসক্তি ছিল না, তিনি নিয়মিত দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন।২৪ সে যাই হোক, তাঁর সময় মুর্শিদাবাদ দরবারে বিশেষ জাঁকজমকের ব্যবস্থা তেমন দেখা যায় না। তাঁর পিতার মতো প্রাসাদ, ইমারত ইত্যাদি নির্মাণও তাঁর রাজত্বে চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ অবশ্য তিনি মাত্র বছরখানেকই রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। তিনি মসনদে বসার পরই সুজাউদ্দিনের দরবারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী তিন অমাত্য/পারিষদ, যাঁদের ‘ত্রয়ী’ বলা হয়— দেওয়ান আলমচাঁদ, ব্যাঙ্কার জগৎশেঠ ফতেচাঁদ ও সৈয়দ আহমেদ— এবং যাঁদের হাতে নবাব সুজাউদ্দিনের সময় বাংলার শাসনক্ষমতাই চলে গেছল, তাঁরা সরফরাজকে সরিয়ে আলিবর্দিকে বাংলার নবাব করার ষড়যন্ত্র করেন। আলিবর্দি, যাঁকে সুজাউদ্দিন বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন, গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০ সালে) সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদ দখল করে নেন।