মুর্শিদকুলির সময় মুর্শিদাবাদের নানারকমের উৎসব ও জাকজমক ছিল দেখবার মতো। তার মধ্যে একটি ছিল পুণ্যাহ, চৈত্র মাসের শেষে জমির রাজস্ব আদায় শেষ হওয়ার পর বৈশাখের প্রথমদিকে হত পূণ্যাহ। ওইদিন মুর্শিদাবাদে সব জমিদাররা বা তাদের প্রতিনিধিরা হাজির হত। মহাসমারোহে চলত পুণ্যাহের উৎসব।১৫ বাংলা থেকে দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর ব্যাপারটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেক বছরই মুর্শিদকুলি রাজস্ব বাবদ নগদ ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা করে পাঠাতেন। তা ছাড়াও খালসা জমি থেকে প্রাপ্ত আয় এবং বাংলা থেকে বহুবিধ চিত্তাকর্ষক জিনিসপত্র রাজস্বের সঙ্গে যেত। এ সবই দু’শোটি শকটে বোঝাই করে ছ’শো অশ্বারোহী ও পাঁচশো পদাতিক সৈন্যের পাহারায় মুর্শিদকুলি নিজে মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। তবে সবচেয়ে বড় জাঁকজমক দেখা যেত হজরত মহম্মদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে। এটা হত রবি-উল-আওয়াল মাসের পয়লা তারিখ থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত। এ ক’দিন নবাব মুর্শিদাবাদ ও নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে জ্ঞানীগুণী, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধুসন্ত, ফকির, শেখ, সৈয়দ, ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে মজলিসে নেমন্তন্ন করে সবাইকে পানাহারে আপ্যায়িত করতেন। শুধু তাই নয়, ওই ক’দিন ভাগীরথীর দক্ষিণে লালবাগ থেকে পশ্চিম তীরের উত্তরে শাহিনগর পর্যন্ত নদীর দু’ধারেই হাজার হাজার চিরাগবাতি দিয়ে সাজানো হত। ওই সব চিরাগের আলোতে মসজিদ, মিনার, গাছপালায় কোরানের শ্লোক ও নানাবিধ কবিতা ফুটে উঠে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হত। মুর্শিদকুলির নির্দেশে নাজির আহমেদ চিরাগের আলো জ্বালাবার জন্য প্রায় এক লক্ষ লোক নিয়োগ করতেন। সন্ধের সময় একবার তোপধ্বনি করে আলো জ্বালাবার সংকেত দেওয়া হত এবং সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার চিরাগবাতি জ্বলে উঠে এক অপূর্ব সুন্দর বাতাবরণের সৃষ্টি করত। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিমের ভাষায় ‘producing an illusion as if a sheet of light had been unrolled, or as if the earth had become a sky studded with stars’.
মুঘলধারা অনুসরণ করে মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারও শুরু করেন। বলা বাহুল্য এ দরবারে রাজ্যের অমাত্যরা শুরু করে ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী, বিদেশি পর্যটক, ইউরোপীয় কোম্পানিরগুলির প্রতিনিধিরা নিয়মিত উপস্থিত হতেন। মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনবিভাগের সংস্কারের ফলে বাংলায় শুধু নতুন এক ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার-মহাজন শ্রেণির আবির্ভাব হয়নি, নতুন এক বড় বড় জমিদার শ্রেণি ও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও উদ্ভব হয়। এদের মধ্যে অনেকেরই নবাবি দরবারে যাতায়াত ছিল। এ দরবারের জাঁকজমক পরবর্তী নবাবদের সময় অনেক বেড়ে যায়। যেহেতু মুর্শিদকুলি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, সেজন্য ধর্মের প্রতিপালনেও তিনি যথেষ্ট নজর দিতেন, যেটা তাঁর পরে বাংলার নবাবদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। রোজ কোরানপাঠ ও মালাজপ করার জন্য তিনি আড়াই হাজার কোরানে পারদর্শী ব্যক্তি ও তসবি (মালাজপক) নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর নিজের রসুইখানা থেকে রোজ দু’বেলা এদের খাবার পরিবেশন করা হত।১৬
যতদূর জানা যায়, তাতে মনে হয় মুর্শিদকুলির সময় মুর্শিদাবাদের সাধারণ লোকদের অবস্থা বেশ ভালই ছিল। এখানে প্রথমে দেওয়ানি ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে নানারকমের নির্মাণকার্য এবং ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী, জমিদার, অমাত্য এ সবের আনাগোনার ফলে কাজকর্মের এবং আয়ের পথও বেশ সুগম হয়। তা ছাড়া মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদ থেকে (সারা বাংলা থেকেও বটে) বাইরে চাল রফতানি একদম বন্ধ করে দেন। অথচ বহুদিন থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে, এমন কী লোহিত সাগর ও পারস্য সাগর অঞ্চলেও, বাংলা থেকে চাল রফতানি হত।১৭ যাই হোক, মুর্শিদকুলি চাল রফতানি বন্ধ করার ফলেই সম্ভবত তাঁর সময় মুর্শিদাবাদে চালের দাম ছিল, গোলাম হোসেন সলিমের তথ্য অনুযায়ী, টাকায় ৫ থেকে ৬ মণ, যদিও সলিমুল্লা বলছেন, টাকায় ৪ মণ। সে অনুপাতে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ছিল সস্তা। ফলে রিয়াজের লেখক বলছেন, মুর্শিদাবাদের লোকেরা তখন মাসে এক টাকা খরচ করলেই পোলাও, কালিয়া খেতে পারত। এটা হয়তো অত্যুক্তি, যদিও এ থেকে অনুমান করা যায় সাধারণ লোকদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছলই ছিল।১৮
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুর্শিদকুলির আমলে বাঙালি হিন্দুদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়। মুসলমান রাজত্ব হলেও তিনি বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগে বাঙালি হিন্দুদেরই শুধু নিযুক্ত করেছিলেন। তার অন্যতম কারণ অবশ্য বাঙালি হিন্দুরা যেমন ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিল, তেমনি রাজস্বের ব্যাপারেও তাদের বেশ দক্ষতা ছিল। তা ছাড়া মুর্শিদকুলির ধারণা ছিল হিন্দুরা রাজস্বের হিসেবে গরমিল করলে বা তা আত্মসাৎ করলে তিনি তাদের কড়া শাস্তি দিতে পারবেন, যেটা মুসলমান কর্মচারী হলে তাঁর পক্ষে করা অসুবিধেজনক ছিল। শাস্তির ভয়ে হিন্দুরা তহবিল তছরূপ বা রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে কোনওরকমের অবহেলা করবে না। তারিখ-ই-বংগালার লেখক সলিমুল্লা লিখছেন:১৯