স্কুলের ছুটি-ছাটা উপলক্ষে অতঃপর গ্রামের বাড়িতে গিয়া এই সব নূতন নূতন কথা বলিতে শুরু করি। আমাদের নেতা জহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব ছাড়াও বৈলর গ্রামের পণ্ডিত ইমান উল্লাহ সাহিত্য-রত্ন সাহেব আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ ও উপদেশ দিতেন।
৬. সাম্প্রদায়িক চেতনা
আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই পীড়া দিত। জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব প্রজার কাছ থনেই কালীপূজার মাথট আদায় করিতেন। এটা খাজনার সাথে আদায় হইত। খাজনার মতই বাধ্যতামূলক ছিল। না দিলে খাজনা নেওয়া হইত না। ফরাযী পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি গোঁড়া মুসলমান ছিলাম। মূর্তি পূজার চাঁদা দেওয়া শেরেকী গোনা। এটা মুরুব্বিদের কাছেই শেখা মসলা। কিন্তু মুরুব্বিরা নিজেরাই সেই শেরেকী গোনা করেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে দাদাজী, বাপজী ও চাচাজী তারা বলিতেন : না দিয়া উপায় নাই। এটা রাজার জুলুম। রাজার জুলুম নীরবে সহ্য করা এবং গোপনে আল্লার কাছে মাফ চাওয়া ছাড়া চারা নাই। এ ব্যাপারে মুরুব্বিরা যদিস-কোরআনের বরাত দিতেন।
কিন্তু আমার মন মানিত না। শিশু-সুলভ বেপরোয়া সাহস দেখাইয়া হাম্বি তাধি করিতাম। মুরুব্বিরা ‘চুপচুপ’ করিয়া ডাইনে-বাঁয়ে নযর ফিরাইতেন। জমিদারের লোকেরা শুনিয়া ফেলিল না ত!
কালীপূজা উপলক্ষ্যে জমিদার কাছারিতে বিপুল ধূমধাম হইত। দেশ-বিখ্যাত যাত্রাপার্টিরা সাতদিন ধরিয়া যাত্রাগান শুনাইয়া দেশ মাথায় করিয়া রাখিত। হাজার হাজার ছেলে-বুড়া সারা রাত জাগিয়া সে গান-বাজনা-অভিনয় দেখিত। সারাদিন মাঠে-ময়দানে খেতে-খামারে এই সব নাটকের ভীম-অর্জনের বাখানি হইত। দর্শক শ্রোতারা প্রায় সবাই মুসলমান। কারণ এ অঞ্চলটাই মুসলমান প্রধান। আমাদের পাড়া-পড়শী আত্মীয়-স্বজন সবাই সে তামাশায় শামিল হইতেন। শুধু আমাদের বাড়ির কেউ আসিতেন না। আমার শিশুমন ঐ সব তামাশা দেখিতে উসখুস করিত নিশ্চয়। পাঠশালার বন্ধুদের পাল্লায় পড়িয়া চলিয়া যাইতাম তার কোন-কোনটায়। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকিতে পারিতাম না। বয়স্ক কারও সংগে দেখা হইলেই তারা বলিয়া উঠিতেন : ‘আরে, তুমি এখানে তুমি যে ফরাযী বাড়ির লোক! তোমার এসব দেখতে নাই।’ শেষ পর্যন্ত আমি ঐ সব তামাশায় যাওয়া বন্ধ করিলাম। কিন্তু বোধহয় কারো নিষেধে ততটা নয়। যতটা শিশু-মনের অপমান-বোধে। কারণ সে সব যাত্রা-থিয়েটারের মজলিসেও সেই কাছারির ব্যবস্থা। ভ ভদ্রলোকদের বসিবার ব্যবস্থা। মুসলমানদের ব্যবস্থা দাঁড়াইয়া দেখার।
০২. খিলাফত ও অসহযোগ
খিলাফত ও অসহযোগ
দুসরা অধ্যায়
১. রাজনীতির পট-ভূমি
আমাদের বাদশাহি ফিরিংগিরা কাড়িয়া নিয়াছে, এই খবরে আমার মনে ফিরিংগি বিদ্বেষ জন্যে বোধহয় আমার জ্ঞানোদয়ের দিন হইতেই। কিন্তু চাচাজী ও দু-চার জন জেহাদী মৌলবীর প্রভাবে কৈশোরে ফিরিংগি বিদ্বেষের জায়গা দখল করে শিখ-বিদ্বেষ। এই শিখ-বিদ্বেষ ইংরাজের প্রতি আমার মন বেশ খানিকটা নরম করিয়া ফেলে।
এই নরম ভাব কয়েকদিন পরেই আবার গরম হইয়া ইংরাজ-বিদ্বেষ দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে। আমি তখন দরিরামপুর মাইনর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এই সময় ঢাকা বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর মিঃ স্টেপটন আমাদের স্কুল পরিদর্শন করিতে আসেন। কয়েকদিন আগে হইতেই আমরা স্কুল ঘর ও আংগিনা সাজানোর ব্যাপারে পরম উৎসাহে খাঁটিতেছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে সাধ্যমত পনির জামা কাপড় পরিয়া পরম আগ্রহে এই ইংরাজ রাজপুরুষকে দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। একজন শিক্ষকের সেনাপতিত্বে কুইক মার্চ করিয়া খানিকদূর আগবাড়িয়া গেলাম সাহেবকে ইস্তোল করিতে। জীবনের প্রথম এই ‘সাহেব’ দেখিতেছি। নূতন দেখার সম্ভাবনার পুলকে গরম রোমাঞ্চ হইতে লাগিল।
শেষ পর্যন্ত সাহেব আসিলেন। হাঁ সাহেব বটে। উঁচায় ছয় ফুটের বেশী। লাল টকটকা মুখের চেহারা। আমার খুব পছন্দ হইল। মাস্টার সেনাপতির নির্দেশে সোৎসাহে সেলিউট করিলাম। সাহেবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়া মমতায় পরিণত হইল সাহেবের সংগীটিকে দেখিয়া। সাহেবের সংগীটি একজন আলেম। তার মাথায় পাগড়ি, মুখে চাপ দাড়ি, পরনে সাদা আচকান ও সাদা চুড়িদার পায়জামা। সাহেব যখন সাথে আলেম নিয়া চলেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে মুসলমান। আমি ভক্তিতে গদগদ হইলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার তুল ভাংগিল। আমাদের স্কুলের সেকেন্ড পন্ডিত জনাব খিদিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের নিকট নিলাম, লোকটা কোনও আলেম-টালেম নয়, সাহেবের চাপরাশী। শিক্ষক না হইয়া অন্য কেউ একথা বলিলে বিশ্বাস করিতাম না। তাছাড়া পভিত সাহেব আমাকে বুঝাইবার জন্য লোকটার কোমরের পেটি ও বুকের তকমা দেখাইলেন। আমার মাথায় আগুন চড়িল। স্টেপল্টন সাহেবের উপর ব্যক্তিগতভাবে এবং ইংরাজদের উপর জাতিগতভাবে আমি চটিয়া গেলাম। অদেখা শিখ-বিদ্বেষের যে ছাই-এ আমার ফিরিংগি-বিদ্বেষের আগুন চাপা ছিল, চোখের-দেখা অভিজ্ঞতার তুফানে সে ছাই উড়িয়া গেল। আমার ইংরেজী-বিদ্বেষ দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। শালা ইংরাজরা আমাদের বাদশাহি নিয়াও ক্ষান্ত হয় নাই। আমাদের আরও অপমান করিবার মতলবে আমাদের পোশাককে তাদের চাপরাশীর পোশাক বানাইয়াছে! এর প্রতিশোধ নিতেই হইবে। আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করিয়া ফেলিলাম, বড় বিদ্বান হইয়া ইনস্পেক্টর অফিসার হইব। নিজে আচকান পায়জামা-পাগড়ি পরিব এবং নিজের চাপশারীকে কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরাইব।