কর্তা ছিলেন আদত রসিক সুজন। তিনি আমার বয়সের, কালচেহারার ও পাঠশালায় পড়ার কথা শুনিলেন। সব শুনিয়া প্রকাশ্য দরবারে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন : “ছোকরা গোকুলের শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের কংশ বংশ ধ্বংস করতেই ওর জন্ম। আমার ডাকে সে ত আসবই না। হয়ত আমারই ওর কাছে যাইতে হৈব।”
সমবেত প্রজারা ও আমার মুরুব্বিরা এটাকে কর্তার রসিকতা বলিয়া বিশ্বাস করিলেন না। কর্তার চাপা রাগ মনে করিলেন। আমার নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তাযুক্ত হইলেন। সভার সভাপতি তরফদার সাহেব কিন্তু আদত কথা ভুলিলেন না। আমার প্রতি কর্তার মনোভাব নরম করিবার উদ্দেশ্যে মোলায়েম কথায় আমাদের দাবি-দাওয়া পেশ করিলেন। তার কুশলী মিষ্টি কথায় কর্তার মন সত্যই নরম হইল। তিনি সভায় গৃহীত প্রস্তাবের কয়েকটি মনযুর করিলেন। বাকীগুলি অন্যান্য জমিদারদের সাথে সলাপরামর্শ করিয়া পরে বিবেচনা করিবেন বলিলেন! যে কয়টি দাবি তখনই মনযুর হয় তার মধ্যে কাছারিতে প্রজাদের বসিবার। ব্যবস্থাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাধারণ প্রজাদের বসিবার জন্য চট ও মাতব্বর প্রজাদের জন্য লম্বা বেঞ্চির ব্যবস্থা হয়। তবে বেঞ্চি উচ্চতায় সাধারণ বেঞ্চের অর্ধেক হয়। সাধারণ বেঞ্চ উচ্চতায় চৌকির সমান। চৌকির সমান উচা বেঞ্চিতে প্রজারা বসিলে আমলা-প্ৰজায় কোনও ফারাক থাকে না বলিয়া এই ব্যবস্থা হয়। আমাদের মুরুব্বিরা এই ব্যবস্থাই মানিয়া লন। তবে সাধারণ প্রজাদের জন্য চটের বদলে পার্টির ব্যবস্থা করিতে অনুরোধ করা হয়। তখনই এ দাবি মানিয়া নেওয়া হইল লো বটে কিন্তু কয়েক বছর পরে হইয়াছিল। এইভাবে ধানীষোলায় প্রথম প্রজা আন্দোলন সফল হয়।
৫. প্রজা আন্দোলনের চারা
দুই বছর পরের কথা। তখন আমি পাঠশালার পড়া শেষ করিয়া দরিরামপুর মাইনর স্কুলে গিয়াছি। গ্রাম্য সম্পর্কে আমার চাচা মোহাম্মদ সাঈদ আলী সাহেব (পরে উঁকিল) এই সময় শহরের স্কুলে উপরের শ্রেণীতে পড়িতেন। তার উৎসাহে আমি আবার একটা প্রজা সভা ডাকি। এই সভার বিবরণী তকালে সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ ও ‘মিহির ও সুধাকরেট ছাপা হয়। ঐ সভায় সাঈদ আলী সাহেবের রচিত একটি প্রস্তাব খুবই জনপ্রিয় হয়। তাতে দাবি করা হয় যে কাছারির নায়েব-আমলা সবই স্থানীয় লোক হইতে নিয়োগ করিতে হইবে। যুক্তি দেওয়া হয়, এতে স্থানীয় শিক্ষিত লোকের চাকরির সংস্থান হইবে। জমিদারের খাজনা সহজে বেশী পরিমাণ আদায় হইবে। কাছারিতে বসার সমস্যাও সহজেই সমাধান হইবে। এটাকে ক্ষুদ্র আকারে ‘ইণ্ডিয়ানিয়েশন-অব-সার্ভিসেস’ দাবির প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে। চাকুরির ব্যাপারে উচ্চস্তরে সরকারী পর্যায়ে যা হইয়া থাকে এখানেও তাই হইল। ইংরাজ সাম্রাজ্য দিল তবু চাকুরি দিল না। জমিদারও তেমনি জমিদারি দিল তবু চাকুরি দিল না। চাকুরিজীবীরা বরাবর এ-ই করিয়াছে। ভবিষ্যতেও করিবে। ‘শির দিব তবু নাহি দিব আমামা’ সবারই জেহাদী যিকির চিরকালের।
আরও তিন বছর পরে। ১৯১৪ সাল। ময়মনসিংহ শহরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। এই সময় জামালপুর মহকুমার কামারিয়ার চরে একটা বড় রকমের প্রজাসম্মিলনী হয়। সম্মিলনীর আগের বিজ্ঞাপনাদি ও পরে ‘মোহাম্মদ’ ও ‘মোসলেম হিতৈষী’ নামক সাপ্তাহিক দুইটিতে সম্মিলনীর বিবরণী পড়িয়া আমি আনন্দে উহূল্প হই। এই বিবরণী হইতেই আমি প্রথম মৌঃ এ. কে. ফযলুল হক, মৌলবী আবুল কাসেম, খান বাহাদুর আলিমুজ্জামান চৌধুরী, বগুড়ার মৌঃ রজিবুদ্দিন তরফদার, ময়মনসিংহের মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী (পরে আমার শ্বশুর), মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রভৃতি নেতা ও আলেমের নাম জানিতে পারি। এঁরা নিশ্চয়ই বড় বড় পণ্ডিত ও বড় লোক। সকলেই গরিব প্রজার পক্ষে আছেন জানিয়া আমার অন্তরে উৎসাহ ও সাহসের বিজলি চমকিয়া যায়। এই সব বিজ্ঞাপন ও কার্যবিবরণী আমি সযত্নে বাক্সে কাপড়-চোপড়ের নিচে লুকাইয়া রাখি। এতে বিভিন্ন প্রস্তাব ছাড়াও বক্তাদের বক্তৃতার সারমর্ম দেওয়া ছিল। মাঝে মাঝে এইসব কাগ্য বাহির করিয়া মনোযোগ দিয়া পড়িতাম। তাতে প্রজাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ও জমিদারী জুলুম সম্পর্কে আমার জ্ঞান বাড়ে। খাজনা মাথট আবওয়াব গাছ কাটা পুকুর খুদা জমি বিকি-কিনি ইত্যাদি অনেক ব্যাপারেই ঐ সম্মিলনীতে প্রস্তাব পাস হইয়াছিল। তার সব কথা আমি তখন বুঝি নাই সত্য, কিন্তু এটা বুঝিয়াছিলাম যে আমি নিজ গ্রামে প্রজাদের বসিবার আসন ও আমলাগিরি চাকুরির যে দাবি ও তুই-তুংকারের যে প্রতিবাদ করিয়াছিলাম, প্রজাদের দাবি তার চেয়ে অনেক বেশী হওয়া উচিৎ।
নিয়মতান্ত্রিক প্রজা-আন্দোলনের ইতিহাসে কামারিয়ার চর প্রজা সম্মিলনী এবং তার উদ্যোক্তা জনাব খোশ মোহাম্মদ সরকার (পরে চৌধুরী) সাহেবের নাম সোনার হরফে লেখা থাকার বস্তু। এই সম্মিলন চোখে না দেখিয়া শুধু রিপোর্ট পড়িয়া প্রজা-আন্দোলনের এলাকা সম্বন্ধে আমার দৃষ্টি প্রসারিত হয়। এর পর আমি বঙ্কিম চন্দ্রের বাংলার কৃষক রমেশ দত্তের বাংলার প্রজা প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং লালবিহারীদের ইংরাজি নভেল ‘বেংগল পেমেন্ট লাইফ’ পড়ি। শেষোক্ত বইটি আমাদের স্কুলের পাঠ্য ছিল।