এর কয়েক দিন পরেই দ্বিতীয় ঘটনা। বৈলর বাজারের পাট হাটায় একটা বিরাট সভা। আমাদের পাঠশালার শিক্ষক জনাব আলিমদ্দিন মাস্টার সাহেবের উৎসাহ ও নেতৃত্বে আমরা ভলান্টিয়ার’ হইলাম। সভায় কয়েকদিন আগে হইতেই আমাদের ট্রেনিং ও সভামঞ্চ সাজানোর কাজ চলিল। ‘ভলান্টিয়ার’, ও ‘খোশ আমদেদ’ কথা দুইটি এই প্রথম শুনিলাম। মুখস্থ করিলাম। নিজের মনের মত অর্থও করিলাম। এইভাবে সভার আগে ও পরে কয়েকদিন ধরিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করিলাম। সভার উচা মঞ্চে দাঁড়াইয়া যারা বক্তৃতা করিলেন এবং যারা কাতার করিয়া বসিয়া রহিলেন, তারা সকলে মিলিয়া আমার কল্পনার চোখের সামনে আলেফ-লায়লার হারুন রশিদ বাদশার দরবারের ছবি তুলিয়া ধরিলেন। ঠিক ঐ সময়েই আলেফ-লায়লা পড়িতেছিলাম কিনা। আর দেখিবই না বা কেন? কাল আলপাকার শেরওয়ানী ও খয়েরী রং-এর উচা রুমী টুপি ত দেখিলাম এই প্রথম। চৌগা-চাপকান-পাগড়ি অনেক দেখিয়াছি। কিন্তু এ জিনিস দেখিলাম এই পয়লা। বড় ভাল লাগিল। গর্বে বুক ফুলিয়া উঠিল। মুসলমানদের মধ্যেও তবে বড় লোক আছে।
ভলান্টিয়ারের ব্যস্ততার মধ্যে বক্তৃতা শুনিলাম কম। বুঝিলাম আরও কম। তবে করতালি ও মারহাবা-মারহাবা শুনিয়া বুঝিলাম বক্তৃতা খুব ভাল হইয়াছে। কিন্তু আমার মন ছিল সভায় যে সব বিজ্ঞাপন ও পুস্তিকা বিতরণ ও বিক্রয় হইয়াছিল তার দিকেই বেশী। বিলি-করা সবগুলি এবং খরিদ-করা কয়েক খানা আমি জমা করিয়াছিলাম। তার মধ্যে মুনশী মেহেরুল্লা সিরাজগঞ্জীর ‘হিতোপদেশ মালা’ ও মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবীর ‘শুভ জাগরণ’ আমাকে খুবই উদ্দীপ্ত করিয়াছিল। ফলে কয়েক দিন পরে আমি নিজেই এক সভা ডাকিলাম।
খুব চিন্তা-ভাবনা করিয়াই সভার জায়গা ঠিক করিলাম। কারো বাড়িতে ত দূরের কথা, বাড়ির আশে-পাশে হইলেও তার গর্দান যাইবে। কাজেই জায়গা হইল বাংগালিয়ার ভিটায় নদীর ধারে। তার আশে-পাশে এক-আধ মাইলের মধ্যে কারও বাড়ি-ঘর নাই। হাটে-বাজারে ঢোল-শহরত করিলে জমিদারের কানে যাইবে। অতএব এক্সারসাই বুকের পাতা ছিঁড়িয়া আশে-পাশের চার-পাঁচ মসজিদের মুছল্লী সাহেবানের খেদমতে ‘ধানীখোলার প্রজা সাধারণের পক্ষে’ দাওয়াত-নামা পাঠাইলাম। কারও ঘড়ি নাই। তবু সভার সময় দিলাম বিকাল চারটা। পাঠশালা চারটায় ছুটি হয়। কাজেই সময়ের আশায় আছে।
৪. প্রজা আন্দোলনের বীজ
উদ্যোক্তারা আগেই সভাস্থলে গেলাম। লোক কেউ আসে নাই। আমরা ব্যাটবল-তিরিকাট (ক্রিকেট) লইয়া রোজ মাঠে যাইতাম। রাখালদেরে লইয়া খলিতাম। কাজেই আমাদের চার-পাঁচ জনকে একত্রে দেখিয়া রাখালরা জমা হইল। কিন্তু ব্যাটল না দেখিয়া ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল। আমরা বলিলাম সভা হইবে। সভার তামাশা দেখিতে তারা থাকিয়া গেল। এক দুই তিন চার করিয়া প্রায় শ খানেক লাক সমবেত হইল। কিন্তু মাতব্বররা একজনও আসেন নাই। কাকে সভাপতি করিয়া সভার কাজ শুরু করিব তাই ভাবিতেছিলাম। এমন সময় পঁচিশ-ত্রিশ জন লোক পিছনে লইয়া সভায় আসিলেন আমাদের গ্রামের শ্রেষ্ঠ মাতব্বর যহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব। ইনি আবুল কালাম শামসুদ্দিনের চাচা। পাঁচ গ্রামের মাতব্বর। জ্ঞানী পণ্ডিত ও সুবক্তা। তাঁকে সভাপতির পদে বরণ করিয়া আমি প্রস্তাব করিলাম। তিনি আসন গ্রহণ করিলেন। সভায় বসার কোনও চেয়ার-টেবিল ছিল না। কাজেই আসন গ্রহণ করিলেন মানে এক জায়গা হইতে উঠিয়া আরেক জায়গায় বসিলেন। পতিত জমি। দুর্বা ঘাস। কাপড় ময়লা হওয়ার কোনও ভয় ছিল না। কাজেই সবাই বসা। জীবনের প্রথম জনসভায় বক্তৃতা করিতে উঠিলাম। বয়স আমার তখন ন বছর। পাঠশালার বার্ষিক সভায় মুখস্থ কবিতা আবৃতি ও লিখিত রচনা পাঠ ছাড়া অন্য অভিজ্ঞতা নাই। কি বলিয়াছিলাম মনে নাই। তবে বক্তৃতা শেষ করিলে স্বয়ং সভাপতি সাহেব ‘মারহাবা মারহাবা’ বলিয়া করতালি দিয়াছিলেন। তার দেখাদেখি সভার সকলেই করতালি দিয়াছিল। আমার পরেই সভাপতি সাহেব দাঁড়াইলেন। কারণ ‘আর কেউ কিছু বলতে চান?’ সভাপতি সাহেবের এই আহ্বানে কেউ সাড়া দিলেন না। সভাপতি সাহেব লম্বা বক্তৃতা করিলেন। মগরেবের ওয়াক্ত পর্যন্ত সভা চলিল। পেন্সিল ও একসারসাইয় বুক পকেটে নিয়াছিলাম। সভাপতি সাহেবের ডিক্টেশন মত কয়েকটি প্রস্তাব লিখিলাম। তাতে কাছারিতে প্রজাদের শ্ৰেণীমত বসিবার আসন দাবি এবং শরার বরখেলাফ কালী পূজার মাথট আদায় মওকুফ রাখিবার অনুরোধও করা হইল। সর্ব সম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হইল। কাগযটি সভাপতি সাহেব নিজের পকেটে নিলেন। বলিলেন আরও কয়েকজন মাতবর লইয়া তিনি জমিদারের সাথে দরবার করিবেন। সভাপতি সাহেবের বক্তৃতায় জমিদারদের অত্যাচার-জুলুমের অনেক কাহিনী শুনিলাম। অনেক নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। সে সব কথা ভাবিতে ভাবিতে বাপজী চাচাজী ও অন্যান্য মাতব্বরের সাথে বাড়ি ফিরিলাম।
অল্পদিন পরেই আমাদের অন্যতম জমিদার মুক্তাগাছার শ্রীযুক্ত যতীন্দ্র নারায়ণ আচার্য চৌধুরী বার্ষিক সফরে আসিলেন। তাঁর কাছে আমার বিরুদ্ধে এবং ঐ সভা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত রিপোর্ট দাখিল করা হইল। যতীন বাবু আমাকে কাছারিতে তলব করিলেন। পিয়াদা আমাকে নিতে আসিলে আমি তাকে বলিলাম : কর্তার কাছে আমার কোনও কাজ নাই। আমার কাছে কর্তার কাজ থাকিলে তিনিই আসিতে পারেন। তৎকালে জমিদারদেরে কর্তা বলা হইত। সম্বোধনেও বিবরণেও। পিয়াদা আমাদের গায়ের লোক। আমার হিতৈষী। আমার গর্দান যাইবে ভয়ে একথা খোদ কর্তাকে না বলিয়া নায়েব আমলাকে রিপোর্ট করিল। আমার বিরুদ্ধে ওদের আখ্যে ছিল। প্রায় বছর খানেক আগে মায়েব বাবুকে তাদের সামনে আমি তুই এর বদলে তুই বলিয়াছিলাম। নায়েব-আমলারা সে কথা ভুলেন নাই। কর্তাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপাইবার আশায় পিয়াদার রিপোর্টটায় রং চড়াইয়া তুই এর পুরান ঘটনাকে সেদিনকার ঘটনারূপে তার কাছে পেশ করেন।