‘তুই’ শুনিয়াই আমার মাথায় আগুন লাগিল। অতিকষ্টে রাগ দমন করিয়া উত্তর দিলাম : চিড়া।
নায়েব বাবু হাকিলেন : আমারে একটু দিয়া যা ত।
সমান জোরে আমি হাকিলাম ও আমার সময় নাই, তোর দরকার থাকে নিয়া যা আইসা।
নায়েব বাবু বোধ হয় আমার কথা শুনিতে পান নাই। শুনিলেও বিশ্বাস করেন নাই। আবার হাকিলেন : কি কইলে?
আমি তেমনি জোরেই আবার বলিলাম : তুই যা কইলে আমিও তাই কইলাম।
নায়েব বাবু হাতের ছিপটা খুঁড়িয়া ফেলিয়া লম্বা-লম্বা পা ফেলিয়া পানির ধার হইতে পুকুরের পাড়ে উঠিয়া আসিলেন। ওঁদের বসিবার জন্য পুকুর পাড়ের লিচু গাছ তলায় চেয়ার-টেয়ার পাতাই ছিল সেদিকে যাইতে-যাইতে গলার জোরে ‘ফরাযী! ও ফরাযী! বাড়ি আছ?’ বলিয়া দাদাজীকে ডাকিতে লাগিলেন। আমি বুঝিলাম, নায়েব বাবু ক্ষেপিয়া গিয়াছেন। সংগী আমলারাও নিশ্চয়ই বুঝিলেন।
তারাও যার-তার ছিপ তুলিয়া নায়েব বাবুর কাছে আসিলেন। আমি নিজের, জায়গায় বসিয়া রহিলাম। কিন্তু নযর থাকিল ঐদিকে। দাদাজীর ডাক পড়িয়াছে কিনা! তামেশগির পাড়ার লোকেরাও নায়েব বাবুকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে। নায়ের বাবু আবার গলা ফাটাইয়া চিৎকার করিলেন : “ফরাজী, তোমারে কইয়া যাই, তোমার নাতি ছোকরা আমারে অপমান করছে। আমরা আর তোমার পুকুরে বড়শি বাইমু না। মুক্তাগাছায় আমি সব রিপোর্ট করুম।”
চিৎকার শুনিয়া আমার বাপ চাচা দাদা কেউ মসজিদ হইতে কেউ বাড়ির মধ্যে হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। সকলেই প্রায় সমস্বরে বলিলেন : কেটা আপনেরে অপমান করছে? কার এমন বুকের পাটা?
নায়েব বাবু সবিস্তারে বলিলেন, আমি তাকে তুই বলিয়াছি। আমার মুরুব্বিদের এবং সমবেত প্রতিবেশীদের সকলেই যেন ভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেলেন। দাদাজী হুংকার দিয়া আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন : এদিকি আয়। পাজি, জলদি আয়।
আমি গিয়া দাদাজীর গা ঘেষিযা দাঁড়াইতে চাহিলাম। দাদাজী খাতির না করিয়া ধমক দিয়া বলিলেন : ওরে শয়তান, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইছস?
আমি মুখে জবাব না দিয়া মাথা ঝুকাইয়া জানাইলাম : সত্যই তা করিয়াছি।
দাদাজী গলা চড়াইয়া আমার গালে চড় মারিবার জন্য হাত উঠাইয়া, কিন্তু মারিয়া, গর্জন করিলেন : বেআদব বেত্তমি, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইলি কোন্ আক্কেলে?
এবার আমি মুখ খুলিলাম। বলিলাম : নায়েব বাবু আমারে তুই কইল কেন?
দাদাজী কিছুমাত্র ঠাণ্ডা না হইয়া বলিলেন : বয়সে বড়, তোর মুরুব্বি। তানি তোরে তুই কইব বইলা তুইও তানরে তুই কইবি? এই বেত্তমিযি তুই শিখছস কই? আমরা তোরে তুই কই না? নায়েব বাবু তানার ছাওয়ালরে তুই কয় না?
আমি দাদাজীর দিকে মুখ তুলিয়া নায়েব বাবুকে এক নযর দেখিয়া লইয়া বলিলামঃ আপনে বাপজী কেউই ত বয়সে ছোট না, তবে আপনেগরে নায়েব বাবু ‘তুমি’ কয় কেন?
দাদাজী নিরুত্তর। কারও মুখে কথা নাই। নায়েব-আমলাদের মুখেও না। আমার বুকে সাহস আসিল। বিজয়ীর চিত্তচাঞ্চল্য অনুভব করিলাম। আড়-চোখে লোকজনের মুখের ভাব দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কারও কারও মুখে মুচকি হাসির আঁচ পাইলাম।
দাদাজী হাতজোড় করিয়া নায়েব বাবুর কাছে মাফ চাহিলেন। বড়শি বাইতে অনুরোধ করিলেন। আমাকে ধমক দিয়া বলিলেন : যা বেত্তমিয শয়তান, নায়েব বাবুর কাছে মাফ চা। বাপের বয়েসী মুরুব্বিরে তুই কইয়া গোনা করছস।
আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়াইয়া বলিলাম : আগে নায়েব বাবু মাফ চাউক, পরে আমি মাফ চামু।
মিটানো ব্যাপারটা আমি আবার তাজা করিতেছি দেখিয়াই বোধ হয় দাদাজী কুঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন : নায়েব বাবু মাফ চাইব? কেন কার কাছে?
আমি নির্ভয়ে বলিলাম : আপনে নায়েব বাবুর বাপের বয়েসী না? আপনেরে তুমি কইয়া তানি গোনা করছে না? তারই লাগি মাফ চাইব নায়েব বাবু আপনের কাছে।
দাদাজী আরও খানিক হৈ চৈ রাগারাগি করিলেন। আমারে ফসিহত করিলেন। উপস্থিত মুরুব্বিদেরও অনেকে আমাকে ধমক-সালাবত দেখাইলেন। আমাকে অটল নিরুত্তর দেখিয়া পাড়ার লোকসহ আমার মুরুব্বিরা নিজেরাই নায়েব বাবুও তার সংগীদেরে জনে-জনে কাকুতি মিনতি জানাইলেন। কিন্তু নায়েব বাবু শুনিলেন না। সংগীদেরে লইয়া মুখে গজগজ ও পায়ে দম্ দম্ করিয়া চলিয়া গেলেন।
আমাদের পরিবারের সকলের ও পাড়ার অনেকের দুশ্চিন্তায় কাল কাটিতে লাগিল। আমার মত পাগলকে লইয়া ফরাযী বাড়ির বিপদই হইয়াছে। এই মর্মে সকলের রায় হইয়া গেল। বেশ কিছুদিন আমিও দুশ্চিন্তায় কাটাইলাম। প্রায়ই শুনিতাম, আমাকে ধরিয়া কাছারিতে এমন কি মুক্তাগাছায়, নিয়া তক্তা-পিষা করা হইবে। দাদী ও মা কিছুদিন আমাকে ত পাঠশালায় যাইতেই দিলেন না। পাঠশালাটা ত কাছারিতেই।
৩. মনের নয়া খোরাক
ইতিমধ্যে দুইটি ঘটনা ঘটিল। এর একটিতে আমার শিশু মনে কল্পনার দিগন্ত প্রসারিত হইল। অপরটিতে আমার সাহস বাড়িল। যতদূর মনে পড়ে সেটা ছিল ১৯০৭ সাল। একদিন চাচাজী মুনশী ছমিরদ্দিন ফরাযী সাহেব শহর হইতে কিছুসংখ্যক চটি বই ও ইশতাহার আনিলেন। বাড়ির ও পাড়ার লোকদেরে তার কিছু কিছু পড়িয়া শুনাইলেন। তাতে আমি বুঝিলাম শহরে বড় রকমের একটা দরবার হইয়া গিয়াছে। কলিকাতা হইতে বড় বড় লোক আসিয়া ঐ দরবারে ওয়ায করিয়াছেন। ঐ সব পুস্তিকায় তা ছাপার হরফে লেখা আছে। আমি সযত্নে ঐ সব পুস্তিকা জমা করিয়া রাখিয়া দিলাম। পাঠশালার পাঠ্য বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঐ সব পুস্তিকা পড়িবার চেষ্টা করিতাম। বুঝিতাম খুব কমই। কিন্তু যা বুঝিতাম কল্পনা করিতাম তার চেয়ে অনেক বেশী। বেশ কিছুদিন পরে বুঝিয়াছিলাম ওটা ছিল মুসলমান শিক্ষা সম্মিলনী। এতে যারা বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর বা এমনি কোনও বড় অফিসার মিঃ শার্প এবং হাইকোর্টের বিচারপতি জাষ্টিস শরফুদ্দিনও ছিলেন। ওঁরা আসলে কারা, তাদের পদবিগুলির অর্থ কি, তা তখন বুঝি নাই। ফলে আমি ধরিয়া নিলাম মুসলমান নবাব বাদশাদের একটা দরবার হইয়া গেল। এই বিশ্বাসের উপর কল্পনার ঘোড়া দৌড়াইতে লাগিলাম।