দাদাজী সম্বন্ধে কিম্বদন্তিগুলি আলেম-ফাযেল মোল্লা-মৌলবীদের মুখে বরঞ্চ কিছুটা সংযত হইয়াই বর্ণিত হইত। কিন্তু পাড়ার বুড়ারা চোখে দেখা বলিয়া যে সব আজগৈবি কাহিনী বয়ান করিতেন, তাতে আমার রোমাঞ্চ হইত এবং দাদাজীর মত ‘বীর’ হওয়ার খাহেশ দুর্দমনীয় হইয়া উঠিত। আমি জেহাদে যাইবার জন্য ক্ষেপিয়া উঠিতাম। কান্নাকাটি জুড়িয়া দিতাম। বেহশতে হুরেরা শরাবন-তহুর পিয়ালা হাতে কাতারে কাতারে শহিদানের জন্য দাঁড়াইয়া আছে, অথচ আমি নাহক বিলম্ব করিতেছি, এটা আমার কাছে অসহ্য মনে হইত। অবশ্য ঐ বয়সে হুরের আবশ্যকতা, তাদের চাঁদের মত সুরতের প্রয়োজনীয়তা অথবা শরাবন তহুরার স্বাদের ভাল-মন্দ কিছুই আমি জানিতাম না। তবু এইটুকু বুঝিয়া ছিলাম যে ঐগুলি লোভনীয় বস্তু। তা যদি না হইবে, তবে হুরের সুরতের কথা শুনিয়া রোমাঞ্চ হয় কেন?
কিন্তু জেহাদের খাহেশ আমার, মিটিল না। মুরুব্বিরা অত অল্প বয়সে বেহেশতে গিয়া দুরের কবলে পড়িতে আমাকে দিলেন না। তারা বুঝাইসেন শাহাদতের পুরা ফযিলত ও হুরের সুরত উপভোগ করিতে হইলে আরও বয়স হওয়া এবং লেখা-পড়া করা দরকার।
অতএব মন দিয়া পড়াশোনা করিতে ও চড়া গলায় সুর করিয়া জেহাদী কেতাব পড়িতে লাগিলাম। কেতাবের সব কথা বুঝিতাম না। তাই উস্তাদ চাচাজীকে জিগ্গাস করিতাম : চাচাজী, লাহোর কই শিখ কি? চাচাজী বুঝাইতেন? লাহোর হিন্দুস্থানেরও অনেক পশ্চিমে একটা মুল্লুক। আর শিখা শিখেরা আর দুশমন। হিন্দুদের মত দুশমন? না, হিন্দু-সে বতর। চাচাজীর কাছে আগে শুনিয়াছিলাম, ফিরিংগীরাই আমাদের বড় দুশমন। কাজেই জিগাইতাম : ফিরিংগীর চেয়েও চাচাজী জবাব দিতেন : ফিরিংগীরা তবু খোদা মানে, ঈসা পয়গাম্বরের উম্মত তারা। শিখেরা তাও না। ধরিয়া নিলাম, শিখেরা নিশ্চয়ই হিন্দু। সে যুগে হানাফী-মোহাম্মদীতে খুব বাহাস মারামারি ও মাইল মোকদ্দমা হইত। চাচাজী মোহাম্মদী পক্ষের বড় পাণ্ডা। তাঁর মতে হানাফীরা হিন্দু-সে বদৃতর। সেই হিন্দুরা আবার নাসারা-সে বতর। তার প্রমাণ পাইতে বেশী দেরি হইল না।
২. আত্মমর্যাদা-বোধ
আমাদের পাঠশালাটা ছিল জমিদারের কাছারিরই একটি ঘর। কাছারিঘরের সামন দিয়াই যাতায়াতের রাস্তা। পাঠশালায় ঘড়ি থাকিবার কথা নয়। কাছারিঘরের দেওয়াল-ঘড়িটাই পাঠশালার জন্য যথেষ্ট। কতটা বাজিল, জানিবার জন্য মাস্টার মশায় সময়-সময় আমাদেরে পাঠাইতেন। ঘড়ির কাঁটা চিনা সহজ কাজ নয় যে দুই-তিন জন ছাত্র এটা পারিত, তার মধ্যে আমি একজন।
কিছু দিনের মধ্যে একটা ব্যাপারে আমি মনে বিষম আঘাত পাইলাম। অপমান বোধ করিলাম। দেখিলাম, আমাদের বাড়ির ও গাঁয়ের মুরুব্বিরা নায়েব আমলাদের সাথে দরবার করিবার সময় দাঁড়াইয়া থাকেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই। আরও কিছু দিন পরে জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে নায়েব-আমলারা ‘তুমি’ বলেন। নায়েব-আমলারা আমাদেরেও ‘তুই তুমি’ বলিতেন। আমরা কিছু মনে করিতাম না। ভাবিতাম, আমাদের মুরুব্বিদের মতই ওরাও আদর করিয়াই এমন সম্বোধন করেন। পরে যখন দেখিলাম, আমাদের বুড়া মুরুব্বিদেরেও তারা ‘তুমি’ বলেন, তখন খবর না লইয়া পারিলাম না। জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে ‘তুমি’ বলা ও কাছারিতে বসিতে না দেওয়ার কারণ একটাই। নায়েব-আমলারা মুসলমানদেরে ঘৃণা-হেকারত করেন। ভ ভদ্রলোক মনে করেন না। তবে ত সব হিন্দুরাই মুসলমানদেরে ঘৃণা করে! হাতে নাতে এর প্রমাণও পাইলাম। পাশের গায়ের এক গণক ঠাকুর প্রতি সপ্তাহেই আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আসিত। কিছু বেশী চাউল দিলে সে আমাদের হাত গণনা করিত। আমাদেরে রাজা-বাদশা বানাইয়া দিত। এই গণক ঠাকুরকে দেখিলাম একদিন নায়েব মশায়ের সামনে চেয়ারে বসিয়া আলাপ করিতেছে। নায়েব মশাই তাকে ‘আপনি’ বলিতেছেন। এই খালি-পা খালি-গা ময়লা ধুতি-পরা গণক ঠাকুরকে নায়েব বাবু এত সম্মান করিতেছেন কেন? আমাদের বাড়িতে তাকে ত কোন দিন চেয়ারে বসিতে দেখি নাই। উত্তর পাইলাম, গণক ঠাকুর হিন্দু ব্রাহ্মণ। কিন্তু আমাদের মোল্লা-মৌলবীদেরেও ত নায়েব-আমলারা ‘আপনে’ বলেন না, চেয়ারে বসান না। আর কোনও সন্দেহ থাকিল না আমার মনে। রাগে মন গিরগির করিতে থাকিল।
কাছারির নায়েব-আমলাদের বড়শি বাওয়ায় সখ ছিল খুব। সারা গায়েব মাতব্বর প্রজাদের বড় বড় পুকুরে মাছ ধরিয়া বেড়ান ছিল তাঁদের অভ্যাস। অধিকারও ছিল। গাঁয়ের মাতব্বরদেরও এই অভ্যাস ছিল। নিজেদের পুকুর ছাড়াও দল বাঁধিয়া অপরের পুকুরে বড়শি বাইতেন তাঁরাও। কিন্তু পুকুরওয়ালাকে আগে খবর দিয়াই তারা তা করিতেন। কিন্তু নায়েব-আমলাদের জন্য পূর্ব অনুমতি দরকার ছিল না। বিনা-খবরে তারা যেদিন-যার-পুকুরে-ইচ্ছা যত-জন খুশি বড়শি ফেলিতে পারিতেন।
একদিন আমাদের পুকুরেও এমনিভাবে তারা বড়শি ফেলিয়াছেন। তাদের নির্বাচিত সুবিধাজনক জায়গা বাদে আমি নিজেও পুকুরের এক কোণে বড়শি ফেলিয়াছি। নায়েব বাবুরা ঘটা করিয়া সুগন্ধি চারা ফেলিয়ো হরেক রকমের আধার দিয়া বড়শি বাহিতেছেন। আর আমি বরাবরের মত চিড়ার আধার দিয়া বাহিতেছি। কিন্তু মাছে খাইতেছে আমার বড়শিতেই বেশী। নায়েব বাবুদের চারায় মাছ জমে খুব। কিন্তু মোটেই খায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া নায়েব বাবু উচ্চসুরে আমার নাম ধরিয়া ডাকিয়া বলিলেন : তোর আধার কিরে?