এ সবের পিছনে একটু ইতিহাস আছে। আমার বড় দাদা অর্থাৎ দাদার জ্যেষ্ঠ সহোদর আশেক উল্লা ‘গাযী সাহেব’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তিনি শহিদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর মোজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হন। কিভাবে এটা ঘটিয়াছিল, তার কোন লিখিত বিবরণী নাই। সবই মুখে মুখে। তবে জানা যায় দাদা জেহাদে যান আঠার-বিশ বছরের যুবক। প্রায় ত্রিশ বছর পরে ফিরিয়া আসেন প্রায় পঞ্চাশ বছরের বুড়া! প্রবাদ আছে তিনি বাংলা ভাষা এক রকম। ভুলিয়া গিয়াছিলেন। অনেক দিন পরে তিনি বাংলা রফত করিতে পারিয়াছিলেন। তার সম্বন্ধে আমাদের পরিবারের এবং এ অঞ্চলের আলেম-ফাযেল ও বুড়া মুরুব্বীদের মুখেই এসব শোনা কথা। আমার জন্মের প্রায় ত্রিশ বছর আগে গাখী সাহেব এন্তেকাল করিয়াছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে এ অঞ্চলে বহু প্রবাদ প্রবচন ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তিনি বালাকুটের জেহাদে আহত হইয়া অন্যান্য মোজাহেদদের সাহায্যে পলাইয়া আত্মরক্ষা করেন। বহুদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরা ফেরা ও তবলিগ করিতে করিতে অবশেষে দেশে ফিরিয়া আসেন। পঞ্চাশ বছরের বুড়া জীবনের প্রথমে বিয়া-শাদি করিয়া সংসারী হন। এক মেয়ে ও এক ছেলে রাখিয়া প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়সে মারা যান। বন্দুকের গুলিতে উরাতের হাড়ি ভাংগিয়া গিয়াছিল বলিয়া তিনি একটু খুঁড়াইয়া চলিতেন। তাছাড়া শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি সুস্থ সবল ছিলেন এবং গ্রামের যুবকদের তলওয়ার লাঠি ও ছুরি চালনার অদ্ভুত-অদ্ভুত কৌশল শিক্ষা দিতেন। ঐ সব অদ্ভুত উস্তাদী খেলের মধ্যে কয়েকটির কথা আমাদের ছেলেবেলাতেও গায়ের বুড়াদের মুখে-মুখে বর্ণিত হইত। অনেকে হাতে-কলমে দেখাইবার চেষ্টাও করিতেন। ঐসব কৌশলের একটি ছিল এইরূপ : চারজন লোক চার ধামা বেগুন লইয়া চার কোণে আট-দশ হাত দূরে দূরে দাঁড়াইত। দাদাজী তলওয়ার হাতে দাঁড়াইতেন চারজনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। তামেশগিররা চারদিক ঘিরিয়া দাঁড়াইত। একজন মুখে বুড়া ও শাহাদত আংগুল ঢুকাইয়া শিস দিত। খেলা শুরু হইত। ধামাওয়ালা চারজন একসংগে দাদাজীর মাথা সই করিয়া ক্ষিপ্র হাতে বেগুন ছুরিতে থাকিত। দাদাজী চরকির মত চক্রাকারে তলওয়ার ঘুরাইতে থাকিতেন। একটা বেগুনও তার গায় লাগিত না। ধামার বেগুন শেষ হইলে খেলা বন্ধ হইত। দেখা যাইত, সবগুলি বেগুনই দুই টুকরা হইয়া পড়িয়া আছে।
দাদাজী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশের নযরবন্দী ছিলেন। সপ্তাহে একবার থানায় হাযির দিতে হইত। তখনও ত্রিশাল থানা হয় নাই’ কতোয়ালিতেই তিনি হাযিরা দিতে যাইতেন।
আশেক উল্লা সাহেব ছিলেন আছরদ্দিন ফরাযী সাহেবের তিন পুত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি তখন মাদ্রাসার ছাত্র। এই সময় আমাদের গ্রাম ধানীখোলা ওহাবী আন্দোলনের ছোট খাট কেন্দ্র ছিল। ডব্লিও, ডরিও, হান্টার সাহেবের ‘স্ট্যাটিসটিক স-অব-বেংগল’ নামক বহু তথ্যপূর্ণ বিশাল গ্রন্থের ৩০৮ পৃষ্ঠায় ধানীখোলাকে ‘ময়মনশাহী’ জিলার পঞ্চম বৃহৎ শহর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ঐ পুস্তকের ৩০৯ পৃষ্ঠায় লেখা হইয়াছে : “জিলার সমস্ত সম্পদ ও প্রভাব ফরাযীদের হাতে কেন্দ্রিভূত। তাদের মধ্যে কয়েকজন বড়-বড় জমিদারও আছেন। এঁরা সবাই ওহাবী আন্দোলনের সমর্থক। অবশ্য এদের অধিকাংশই গরীব জোতদার। এদেরই মধ্যে অল্প-কয়েকজন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিদ্রোহী ধর্মান্ধদের শিবিরে যোগ দিয়াছিল।”
হান্টার সাহেব-বর্ণিত এই ‘অল্প-কয়েকজন’ আসলে কত জন, কোথাকার কে কে ছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গবেষকরাই তা ঠিক করিবেন। ইতিমধ্যে আমি সগৌরবে ঘোষণা করিতেছি যে আমার বড় দাদা গাযী আশেক উল্লা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। আমাদের পারিবারিক প্রবাদ হইতে জানা যায়, টাংগাইল (তৎকালীন আটিয়া) মহকুমার দুইজন এবং জামালপুর মহকুমার একজন মোজাহেদ-ভাই তার সাথী ছিলেন। দাদাজী জীবনের শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করিয়াছিলেন। ভাগ্যক্রমে দাদাজীর এন্তেকালের প্রায় ষাট বছর পরে আমি তাঁরই এইরূপ এক মোজাহেদ-ভাইর প্রপৌত্রীকে বিবাহ করিয়াছি।
ঐ সব বিবরণ হইতে বুঝা যায় ধানীখোলা এই সময় ওহাবী আন্দোলনের। ছোট খাট আখড়া ছিল এবং সেটা ছিল আমাদের বাড়িতেই। আমার আপন দাদাজী আরমাল্লা ফরাজী সাহেবের এবং আরও বহু মুরুব্বি আলেম-ফাযেলের মুখে শুনিয়াছি যে শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভী সাহেবের সহকর্মীদের মধ্যে মওলানা এনায়েত আলী এবং তার স্থানীয় খলিফা মওলানা চেরাগ আলী ও মওলানা মাহমুদ আলী এ অঞ্চলে তবলিগে আসিতেন এবং আমাদের বাড়িতেই অবস্থান করিতেন। এদের প্রভাবে আমার প্রপিতামহ আছরদ্দিন ফরাযী সাহেব তার জ্যেষ্ঠ এবং তৎকালে একমাত্র অধ্যয়নরত পুত্রকে মোজাহেদ বাহিনীতে ভর্তি করান। তার ফলে প্রতিবেশীও আত্মীয়-স্বজনের চক্ষে আমার পরদাতার মর্যাদা ও সম্মান বাড়িয়া যায়। তাই অবশেষে পারিবারিক মর্যাদায় পরিণত হয়।
আমরা ছেলেবেলায় এই ঐতিহ্যেরই পরিবেশ দেখিয়াছি। জেহাদী মওলানাদের আনাগোনা তখনও বেশ আছে। বিশেষতঃ মগরেবের ও এশার নমাযের মাঝখানে মসজিদে এবং এশার নমাযের পর খানাপনা শেষে বৈঠকখানায়, যেসব আলোচনা হইত তার সবই জেহাদ শহিদ হুর বেহেশত দুখ ইত্যাদি সম্পর্কে। এই সব আলোচনার ফলে আলেম-ওলামাদের সহবতে আমার শিশু-মনে ঐ সব দুর্বোধ্য কথার শুধু কল্পিত ছবিই রূপ পাইত। ফলে আমার মধ্যে একটা জেহাদী মনোভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দানা বাঁধিয়া উঠিতেছিল।