উপমহাদেশীয় এই ঐক্যজোটে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক কারণেই নেতৃত্ব দিবে ভারত। ভাররে এটা দাবি করিতে হইবে না। প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করিলেই। তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াই তাকে নেতা মানিবে। দাবি করিলে বরঞ্চ এই স্বাভাবিক গতি বিধিত হইবে। তা ছাড়া ভারত যখন সকল ব্যাপারে সত্যই বড়, সেই কারণেই উদার হওয়া তারই পক্ষে সম্ভব। এটা তার কর্তব্যও। ছোটদের মধ্যে যে কমপ্লেক্স থাকিবার কথা, ভারতের তা থাকিতে পারে না। ঘোট ও দুর্বলের জন্য যেটা হীনমন্যতা, বড় ও সবলের জন্য সেটাই উদারতা ও মহত্ত্ব। এই কারণেই ভারত যখন এর ব্যত্যয় করে, তখন আমি দুঃখিত হই। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও রাষ্ট্র যখন নিতান্ত সদিচ্ছা লইয়াও ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ মিটাইবার কথা বলে, তখন ভারতের কেউ কেউ বলিয়া বসেন, ভারত ও পাকিস্তানকে সমপর্যায়ে ফেলিয়া বিচার করা উচিৎ না। কথাটা যে-অর্থেই বলা হউক না কেন, এটার ভুল ব্যাখ্যা হইতে পারে। বরঞ্চ ভারতের নেতৃত্ব যখন প্রকৃতির দান, তখন ভারত বলিবে : আমি নেতা নই; এই উপমহাদেশের সবাই সমান; এখানকার নেতৃত্ব সমবেত নেতৃত্ব। নেতা যত বেশী বলেন : আমি নেতা নই, তাঁর নেতৃত্ব তত জোরদার ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৮. এশীয় ঐক্যজোট
এই পথে উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট গঠিত হইলে পরবর্তী পদক্ষেপই হইবে এশীয় ঐক্যজোট। আজ ইউরোপীয় ঐক্য ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার মতই এশীয় ঐক্য ও এশীয় নিরাপত্তার কথা সত্য হইতে চলিয়াছে। ঐক্য ও নিরাপত্তা আজ আর অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় সীমিত নয়। সেটা বরঞ্চ আজ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতায় রূপান্তরিত হইতেছে। ইউরোপীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য আজ সোভিয়েট ব্লক ও পশ্চিমা গণতন্ত্রী রাষ্ট্র সমবেতভাবে চেষ্টা করিতেছে। এশিয়াতেও এটা হইতে বাধ্য। বলিতে গেলে এশিয়া মহাদেশই এ বিষয়ে অন্যান্য মহাদেশের পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে। মার্কিন মহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্রই অর্গেনিযেশন-অব-আমেরিকান স্টেট (ও. এ. এস) গঠন করিয়াছে সকলের আগে। আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয় রাষ্ট্রগুলিও ইতিপূর্বেই অর্গেনিযেশন-অব-আফ্রিকান ইউনিটি (ও. এ. ইউ) গঠন করিয়া ফেলিয়াছে। ইউরোপীয় মহাদেশের পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূরে ই.ই.সি. সংস্থা ও রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজবাদী রকের মধ্যে ঐক্যজোটের চেষ্টার কথা ত আগেই বলিয়াছি। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্রের এসোসিয়েশন-অব-সাউথ-ইস্ট এশীয়ান স্টেট (এশিয়ান), আরব লীগ ও রক ইরান-পাকিস্তানের আর, সি, ডি.-কে এশীয় ঐক্যজোটের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বিচার করিতে হইবে। এশীয় ঐক্যজোটের নেতৃত্ব পাইবে চীন প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক কারণেই। চীন ও ভারতের বিরোধ এই ঐক্যজোটের প্রতিবন্ধক হইবে, মনে হইতে পারে। কিন্তু আমি যে পরিবেশের কল্পনা করিতেছি, তাতে চীন-ভারত বিরোধের অবসান হইবেই। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার কাশির-বিরোধের মীমাংসা হইতে পারিলে চীন-ভারতের ম্যাকমেইন লাইনের বিরোধ মিটান যাইবে না কেন? চীন-ভারতের বিরোধ মিটানোর ব্যাপারে আগামীতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারে। এ বিষয়ে এবার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যে ভূমিকা পালন করিবে, সেটা হইবে ৬০-৬২ সালের ভূমিকা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ব-শান্তি আজ গোটা দুনিয়ার শ্লোগান। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই এটা অপরিহার্য। এই বিশ্বশান্তির পদক্ষেপ হিসাবে এশীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা যখন সম্যক উপলব্ধ হইবে, তখন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দুইটি রাষ্ট্র ভারত ও চীন সে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কোনও ত্যাগ স্বীকারকেই অসাধ্য বিবেচনা করিবে না।
অতএব দেখা গেল, বিশ্বশান্তির জন্য এশীয় ঐক্য এবং এশীয় ঐক্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই উপমহাদেশীয় ঐক্য-শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকা হইবে অনন্য সাধারণ। বস্তুতঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম এই বিপুল সম্ভাবনার বিশাল ভোরণ-দ্বার খুলিয়া দিয়াছে।
বাংলাদেশের নয়া নেতৃত্ব এই বিপুল সম্ভাবনাকে সফল করিয়া তুলুন, খোদার দরগায় এই মোনাজাত করিয়া আমার এই বই সমাপ্ত করিলাম। খোদা হাফেজ। ১৬ই নবেম্বর ১৯৭৩।