বাংলাদেশের জাতীয় রূপ ও তার শিল্প-সাহিত্যের প্রাণ ও আংগিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করিতে হইলে গত ছয়শ বছরের বাংলার ইতিহাসকে দুইভাগে বিচার করিতে হইবে। ইংরাজ আমলের দুই শ বছর বাংগালী মুসলমানদের অন্ধকার যুগ। এই যুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের কোনও অবদান বা শরিকি নাই। এটা সম্পূর্ণভাবে একক হিন্দুদের সাহিত্য-সংস্কৃতি। এই যুগের মুসলমানদেরে দেখিয়াই হিন্দু লেখক সাহিত্যিকরা বলিয়া থাকেন : বাংগালী মুসলমানদের কাছে একটি মাত্র কালচার তার নাম এগ্রিকালচার। এ অবস্থায় ‘বাংগালী কালচার’, ‘বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি’ বলিতে তাঁরা যে হিন্দু-বাংলার সংস্কৃতি বুঝিয়া থাকেন, তাতে তাঁদেরে দোষ দেওয়া যায় না। সে কালচার যে অবিভাজ্য, তাও সত্য কথা। কারণ সে কালচারের হেঁসেল শ্রীকান্তের টগর বৈষ্টবীর হেঁসেলের মতই অলংঘ্য।
কিন্তু ইংরাজ আমলের আগের চারশ বছরের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। সেখানেও তাদের রূপ বাংগালী রূপ। সে রূপেই তারা বাংলাভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার স্বাধীনতার জন্য দিল্লীর মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার বার ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করিয়াছিলেন। এই যুগ বাংলার মুসলমানদের রাষ্ট্রিক, ভাষিক, কৃষ্টি ও সামরিক মনীষা ও বীরত্বের যুগ। সে যুগের সাধনা মুসলিম নেতৃত্বে হইলেও সেটা ছিল উদার অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-বৌদ্ধরাও ছিল তাতে অংশীদার। এ যুগকে পরাধীন বাংলার রূপ দিবার উদ্দেশ্যে হাজার বছর পরে আজ বাংলা স্বাধীন হইয়াছে বলিয়া যতই গান গাওয়া ও স্লোগান দেওয়া হউক, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে ভূলান যাইবে না। আৰ্য জাতির ভারত দখলকে বিদেশী শাসন বলা চলিবে না; তাদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত, কায়েস্থকে বিদেশী কলা যাইবে না, শুধু শেখ সৈয়দ-মোগল পাঠানদেরেই বিদেশী বলিতে হইবে, এমন প্রচারের দালালরা পাঞ্জাবী দালালদের চেয়ে বেশী সফল হইবে না। এটা আজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, কৃষ্টিক স্বকীয়তাই রাষ্ট্রীয় জাতীয় স্বকীয়তার বুনিয়াদ। কাজেই নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের কৃষ্টিক স্বকীয়তার স্বীকৃতি উপমহাদেশের তিন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতা-ভিত্তিক স্থায়ী শাস্তির ভিত্তি হইবে।
৬. উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট
এইভাবে তিনটি জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যকার সাবেক ও বর্তমান বিরোধসমূহ এবং ভবিষ্যৎ বিরোধের সম্ভাবনা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মিটাইয়া ফেলিবার পরই আমাদের প্রকৃত গঠনমূলক কাজ শুরু হইবে। তিনটি রাষ্ট্র আজ নিজ-নিজ প্রতিরক্ষার নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতেছে, তার আর দরকার থাকিবে না। সে অর্থ অতঃপর জনগণের সেবায় নিয়োজিত হইবে। উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে তখন সামগ্রিকভাবে বিচার করিবার সময় আসিবে। সমবেত বৈজ্ঞানিক কারিগরি উপায়ে সে সম্পদের সৃমবায়িত সদ্ব্যবহার হইবে। শুরু হইবে সেটা উপমহাদেশের অর্থনৈতিক জোটে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিটি ধরনের ঐক্যজোট হইবে আমাদের মডেল। এটা সফল হইলে চোরাচালান ও কালোবাজারি ইত্যাদি উপমহাদেশীয় অনেক অর্থনৈতিক সমস্যারই সমাধান হইবে। পরিণামে এই ঐক্য জোটে শ্রীলঙ্কা, বার্মা, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আফগানিস্তান আকৃষ্ট হইবে। আকৃষ্ট তাদের হইতেই হইবে। শান্তি-নিরাপত্তা তাদেরও দরকার। শান্তি আসতে পারে ঐক্য জোটের মাধ্যমেই। মনে রাখিতে হইবে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াইবার একমাত্র উপায় বিশ্ব-শান্তি। বিশ্বশান্তি বড় কাজ। এক ধাপে তা আসিবে না। আঞ্চলিক শান্তি হইতে মহাদেশীয় শান্তি এবং মহাদেশীয় শান্তি হইতেই বিশ-শান্তি। তাই বিশ্ব-নেতৃত্ব আজ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার ধারণাটা মানিয়া লইয়াছেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে তার আলোনা করিব। এখানে শুধু আঞ্চলিক শান্তির কথাই বলিতেছি। আঞ্চলিকই হউক আর বিশ্বই হউক শান্তির বড় শত্রু অস্ত্র নির্মাতা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। অস্ত্র-শিল্প যাদের কায়েমী স্বার্থ হইয়া গিয়াছে, শান্তি তাদের স্বার্থবিরোধী। রোগ-ব্যাধি না থাকিলে ডাক্তার-ফার্মেসীর যে দশা, মালি-মোকদ্দমা থাকিলে উকিল-টাউটদের যা অবস্থা, যুদ্ধ না জানিলে অ-পিপতিদেরও সেই অবস্থা। সৌভাগ্যবশতঃ উপমহাদেশের হিন, রাষ্ট্র ও তাদের উপরোল্লিখিত পড়শীদের কেউই আমরা যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে আজো ‘শিল্পোন্নত’ হই নাই। যুদ্ধ ফেলিয়া শান্তি ধরিবার এটাই আমাদের মাহেন্দ্রক্ষণ। এটা.এখন আমাদের লাভের কারবার। আমাদের মধ্যে অস্ত্র-নির্মাণের কায়েমী স্বার্থ একবার গড়িয়া উঠিলে শান্তি স্থাপন হইবে তখন লোকসানের কারবার। শান্তির মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানা বখিবে তার পরিণতি খুবই ত হইবে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ধারাটি যেমন রাজনৈতিক ঐক্যের দিকে হাত বাড়াইতেছে, আমাদের ঐক্যজোটও তেমন পরিণতি লাভ করিতে পারে। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে ইং সেন্টারিস্ট ও ইউনিয়নিস্টদের মোকাবিলায় ফেডারেলিস্টদের প্রাধান্য যত বাড়িবে, সর্ব ভারতীয় ও সর্ব-উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক ঐক্য ও পুনর্মিলন ততই বাঞ্ছনীয় ও সহজ হইয়া উঠিবে।