শিমলা চুক্তি এ সব ব্যাপারে হইবে একটি আদর্শ দলিল। এটা দৃশ্যতঃ ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত হইলেও কার্যত এটা তিন রাষ্ট্রেরই চুক্তিপত্র। এর মধ্যে গোটা উপমহাদেশের কল্যাণের পন্থা নির্ধারিত ও নির্দেশিত হইয়াছে। এই চুক্তি আন্তরিকতার সাথে কার্যকর করিলেই স্পিরিট-অব-পার্টিশন বাস্তবায়িত হইবে। উপমহাদেশের চিরস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রীর যে মহা পরিকল্পনা লইয়া ‘৪৭ সালে ভারত বর্ষ ভাগ হইয়াছিল, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পথে উন্নতি অগ্রগতির যে সোনালী স্বপ্ন দেখিয়া কংগ্রেস-নেতৃত্বে হিন্দুরা দেশের তিন-চতুর্থ মেজরিটি হইয়াও এক-চতুর্থ মাইনরিটি মুসলমানদের দাবিতে দেশ ভাগ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন, সেই স্পিরিটকে পুনরুজ্জীবিত ও বাস্তবায়িত করিয়া সেই সোনালী স্বপকে সফল করিতে হইবে। পঁচিশ বছরের পাক-ভারত সহযোগিতা যে স্পিরিট-অব-পার্টিশন রূপায়িত করিতে পারে নাই, আজ বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের সহযোগিতা সেটাকে বাস্তবায়িত করিবেই। তিন রাষ্ট্রের মধ্যে এই দৃঢ় মনোভাব সৃষ্টি করিতে হইবে। স্পিরিট–অব-পার্টিশন বাস্তবায়নের পঁচিশ বছরের ব্যর্থতা হইতে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। অপরের কাঁধে দোষ চাপাইয়া সে ব্যর্থতার কৈফিয়ত দিলে চলিবে না। দোষ নিশ্চয়ই উভয় পক্ষেরই আছে। অপর পক্ষ দেখাইয়া দিবার আগেই যদি আমি নিজের দোষ বুঝিতে পারি, তবে উভয় পক্ষেরই সুবিধা হয়। উভয় পক্ষেরই এই সুবিধার কথাটা আগে পশ্চিম ফ্রন্টে প্রয়োগ করা যাক।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার স্থায়ী শান্তির কাঁটা জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যা। পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা উভয় পক্ষকে বাস্তবাদী হইবার ইংগিত দিতেছে। পাকিস্তানকেও স্বীকার করিতে হইবে, তার পক্ষে জাতিসংঘের প্রস্তাব পঁচিশ বছরেও কাজে লাগে নাই। ভারতকেও স্বীকার করিতে হইবে, শুধু দখলটাই ন্যায় সৃষ্টি করে না, শান্তি প্রতিষ্ঠা ত করেই না। কাজেই উভয় পক্ষকেই কাশ্মির বাটোয়ারায় রামি হইতে হইবে। নেহরুজী বাঁচিয়া থাকিলে ‘৬৫ সালের যুদ্ধের আগেই এটা মিটিয়া যাইত। নেহরু-আইউবের মধ্যে কাশির বাঁটোয়ারার যে স্কিম প্রায় গৃহীত হইয়া গিয়াছিল, সেই ধরনের কিছু-একটা পুনরায় বিবেচনা করিতে হইবে। উপমহাদেশের স্থায়ী শাস্তির যে মহান উদ্দেশ্য লইয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব ’৪৭ সালে ভারত বর্ষ বাটোয়ারায় রাযি হইয়াছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্যের সাফল্যকে নিশ্চিত করিবার প্রয়োজনেই কাশির-বাটোয়ারায় রাবি হইতে হইবে। এটা না করাকেই আমি ১৯৫৭ সালে পণ্ডিত নেহরুর কাছে শান্তির জন্য গাছ-বাটোয়ারার পর পাতাপতুড়ি লইয়া অশান্তি জিয়াইয়া রাখার সাথে তুলনা করিয়াছিলাম। পণ্ডিতজীর নামটা যখন উঠিয়াই পড়িল, তখন শুধু কাশ্মীর সম্পর্কে কেন, বাংলা সম্পর্কেও তাঁর চিন্তা ধারার সাথে আমাদের পরিচয় থাকাদরকার। ‘এপার বাংলা-ওপার-বাংলার’ প্রগতিবাদীদের জন্যই এটা বেশী দরকার। এ সম্পর্কে এই বই-এর চব্বিশা অধ্যায়ের ‘ভারত সফরের’ ৪৪১ পৃষ্ঠায় ‘নেহরুর সাথে নিরালা তিনঘন্টা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটির দিকে আমি পাঠকগণের মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছি। সেখানে দেখিবেন, পণ্ডিতজীর মতে ‘ভারত নিজের স্বার্থেই দুই বাংলার একত্রীকরণের বিরোধী।‘ এই বিরোধের কারণ সুস্পষ্ট। ‘যুক্ত বাংলা’ স্বাধীন সার্বভৌমই হউক, আর ভারত ইউনিয়নের অংগ-রাজ্যই হউক, উভয়টাই সংঘাতের পথ। বাস্তবতার বিচারে ওটা অসম্ভব, ভারত-বাংলাদেশ-মৈত্রীর দিক হইতে অবাঞ্ছনীয়, উপ-মহাদেশীয় শান্তির পরিপন্থী। এ সব জানিয়াও যাঁরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও অপর স্বাধীন রাষ্ট্রের একটা অংগ-রাজ্যকে সমমর্যাদার স্তরে আনিয়া কথা বলেন, তাঁরা সাধারণভাবে উপমহাদেশীয় শান্তির বিরুদ্ধে ও বিশেষভাবে ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন। উভয় রাষ্ট্রের শান্তিবাদী দেশপ্রেমিকদেরই এটা বিষবৎ পরিত্যজ্য। পূর্বাঞ্চলের স্থাপিত শান্তির বিরুদ্ধে নতুন উস্কানি না দিয়া অবশিষ্ট বিরোধ মিটানোর দিকেই সকলের দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। কাশ্মির-প্রশ্নটাই এই অবশিষ্ট বিরোধ। এর সমাধান-চেষ্টাই পুনঃপুনঃ করা উচিৎ। ১৯৬২ সালে যেটা হইতে-হইতে হয় নাই, ১৯৭৩ সালে সেটা হইতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেই আপোস হইয়া যাইবার পরিবেশ এখন সৃষ্টি হইয়াছে। প্রয়োজন হইলে এমন মহৎ কাজে বাংলাদেশ মধ্যস্থতা করিতে পারে। উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তিতে তিনটি রাষ্ট্রেরই স্বার্থ সমভাবে জড়িত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধ মিটাইতে ভারত, ভারত-পাকিস্তান বিরোধ মিটাইতে বাংলাদেশ এবং ভারত-বাংলাদেশ বিরোধ মিটাইতে পাকিস্তান আগাইয়া আসিবে, এটা শুধু স্বাভাবিক নয়, পারস্পরিক কর্তব্যও বটে।
৫. বাংলাদেশের কৃষ্টিক স্বকীয়তা
পূর্ব-প্রান্তের সমস্যাটা রাজনৈতিক না হইলেও তার গুরুত্বও কম নয়। ইংরাজ আমলের দুই শ বছর আজকার বাংলাদেশ ছিল কলিকাতার হিস্টারল্যাণ্ড। কাঁচামাল সরবরাহের খামার বাড়ি। পঁচিশ বছরের পাকিস্তান আমলে এই খামারে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও কিছু শিল্প বাণিজ্য গড়িয়া উঠিয়াছে সত্য, কিন্তু কৃষ্টিক স্বকীয়তা আজিও গড়িয়া উঠে নাই। পাকিস্তান সরকারের এদিককার চেষ্টা ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে পশ্চিম-পাকিস্তানী কৃষ্টি চালাইবার অপচেষ্টা, পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব কালচার উন্নয়নের কোনও চেষ্টা হয় নাই। বাংগালী মুসলমানদের যে নিজস্ব কোনও কালচার আছে, সে উপলব্ধিই পশ্চিমা শাসকদের ছিল না। তাঁরা বাংলা ভাষাকে যেমন হিন্দুর ভাষা মনে করিতেন, বাংলার কৃষ্টি অর্থেও তেমনি হিন্দু কৃষ্টি বুঝিতেন। পাঞ্জাবী-সিন্ধী ভাষা-কৃষ্টির মতই বাংলাদেশেও একটা মুসলিম-প্রধান দৈশিক ভাষা-কৃষ্টি গড়িয়া উঠিতে পারে তা যেন তাঁদের মাথায় ঢুকেই নাই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-বাণিজ্য এখন যেমন তাকে অর্থনীতিতে স্বয়ম্ভর করিবে, নিজস্ব কৃষ্টি সাহিত্যেও তেমনি এ দেশ জাতীয় স্বকীয়তা লাভ করিবে। বাংলাদেশ আর আগের মত কলিকাতার সাহিত্যকর্মের বাজার থাকিবে না।