বাংলাদেশ-নেতৃত্ব আরো একটা ভাল কাজকরিয়াছেন। বাংগালী জাতির সংখ্যা সীমা নির্দেশ করিয়াছেন সাড়ে সাত কোটি। এটা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা। এই ঘোষণার দরকার ছিল। আমাদের বাংগালী জাতীয়তার মূলনীতিতে ভারতের আতংকিত হইবার কারণ ছিল। ভারতে পাঁচ-ছয় কোটি নাগরিক আছেন যারা গোষ্ঠী গোত্র ও ভাষায় বাংগালী। এরা এককালে ছিলেন সারা ভারতের চিন্তা নায়ক। রাজনীতিতেও তাঁরা সারা ভারতকে নেতৃত্ব দিয়াছেন। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে কংগ্রেস-নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয়তা গ্রহণ করিবার আগেতক ঐরা বাংগালী জাতীয়তার, বাংগালী কৃষ্টি, বাংলার স্বাতন্ত্রের মুখর প্রবক্তা ছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তার বৃহত্তর উপলব্ধিতে সেদিনকার সে বাংগালী-আবেগের অবলুপ্তি ঘটিয়াছে কি না, নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় এবং সে রাষ্ট্রের বাংগালী জাতীয়তাবাদের স্লোগানে ভারতীয় বাংগালীদের মধ্যে যুক্ত বাংলা ও বৃহত্তর-বাংলার আকর্ষণে বিভ্রান্তি ঘটা অসম্ভব নয়। এমনিতেই পূর্ব ভারতে একটু অস্থিরতা বিরাজ করিতেছে। তার উপর বাংগালী জাতীয়তার আবেগের ছোঁয়াচ লাগিতে দেওয়া উচিত হইবে না। এই কারণেই বাংগালী জাতীয়তার ব্যাপারে ভারত একটু সতর্ক। আমাদের রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতির এক নীতি জাতীয়তায় তাই ভারত সরকারের অনীহা। ভারত সরকারের দলিল-দস্তাবেযে, নেতা-মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমাদের মূলনীতির তিনটার উল্লেখ থাকে। জাতীয়তাবাদের উল্লেখ থাকে না। বাংলাদেশের নেতৃত্ব ভারত সরকারের ও ভারতীয় নেতৃত্বের এই ইশারা বুঝিয়াছেন। তাই ঐ সাড়ে সাত কোটি বাংগালীর উল্লেখ। বস্তুতঃ ভারতীয় বাংগালীরা আর রাজনৈতিক অর্থে নেশন নন। তাঁরা এখন ভারতীয় নেশন। বাংগালীর পলিটিক্যাল নেশনহুডের ওয়ারিসি এখন ঐতিহাসিককারণেই বাংলাদেশেরউপর বর্তাইছে।
৩. লেজের বিষ
উভয় রাষ্ট্রের এই সুস্পষ্ট দৃঢ়তার লড়াঘাতে বিভ্রান্তির সাপের মাথাটা গুড়া হইয়াছে সত্য। কিন্তু সাপ আজও তার লেজনাড়িতেছে। এবং সাপের বিষ লেজে। তাই উম্মু রাষ্ট্রের কোনও কোনও অরাজনীতিক ও ‘বিদগ্ধ’ বুদ্ধিজীবীরা ‘পাকিস্তান ভাংগা’র ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা’র একাডেমিক ও থিওব্রেটিক্যাল ‘নির্ভুলতা’ আজও কপচাইয়া যাইতেছেন। এই সব বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিসহ মন-অন্তর ও কলিজা দগ্ধ হইলেও তাঁদের মুখটা দন্ধ হইতে এখনও বাকী আছে। তাই তাঁদের মুখে শাশ্বত বাংলা, প্রবহমান বাংলা, সোনার বাংলা, হাজার বছরের বাংলা, গুরুদেবের বাংলা, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, ইত্যাদি নিতান্ত ভাবাবেগের কবিত্বপূর্ণ কথাগুলিও রাজনৈতিক চেহারা লইয়া দেশে-বিদেশে বিষ ছড়াইতেছে। আমাদের দিক হইতেও বংগবন্ধু, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, কবিগুরুর বাংলা, রূপসী বাংলা ইত্যাদি প্রতিধ্বনি করিয়া এপার-বাংলা-ওপার বাংলার ব্যাপারটাকে দুইটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় স্বাতন্ত্রের সীমান্তরেখা মসিলিপ্ত হইতে দিতেছি। আমাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অবস্থা, আমাদের বাংগালী জাতীয়তাবাদ, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, আমাদের জাতীয় সংগীত ও ভারতীয় জাতীয় সংগীত একই কবিগুরুর রচনা হওয়াটারও বিকৃতি করণের সুযোগ করিয়া দিতেছে। পাকিস্তানসহ দুনিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ যে আজও আমাদের দেশকে স্বীকৃতি দিতেছে না, আমাদের দেশবাসীসহ দুনিয়ার সব মুসলমানরা যে ভারত সরকারের প্রতি নাহক ও অন্যায় বৈরীভাব পোষণ করিতেছে, তার প্রধান কারণও এই বিভ্রান্তি।
অথচ প্রকৃত অবস্থাটা এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাংগে নাই; দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর-প্রস্তাব মত দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন। তাঁরা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র। দুই রাষ্ট্রের নামই পাকিস্তান হয় নাই, তাতেও বিভ্রান্তির কারণ নাই। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্র-নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে পাকিস্তান। আমরা পূরবীরা রাখিয়াছি বাংলাদেশ। এতে বিভ্রান্তির কোনও কারণ নাই।
৪. অবিলম্বে কি করিতে হইবে?
অতএব কাল বিলম্ব না করিয়া নর্মাল অবস্থায় ফিরিয়া যাইতে হইবে। পাকিস্তান বাংলাদেশ পরম্পরকে স্বীকৃতি দিয়া তিন রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করিতে হইবে। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আপোস আলোচনার মাধ্যমে নয়া ও সাবেক সমস্ত বিবাদ-বিতর্ক মিটাইয়া ফেলিতে হইবে। যুদ্ধবন্দীদেরমুক্তি দিয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ১০ই জানুয়ারির বিঘোষিত উদার-নীতি কার্যকর করিবে বাংলাদেশ। আর পঁচিশ বছরের নাহোক, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জায়দাদের অংশ দিয়া বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে সাহায্য করিবে পাকিস্তান। পঁচিশ বছরের এজমালী সংসারের লেনদেনে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যে পারস্পরিক গড়িয়া উঠিয়াছে, আজ দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে সেই পারস্পরিকতাকে জনগণের উপকারে লাগাইতে হইবে। লড়াই করিয়া পাকিস্তান-বাংলাদেশ পৃথক হইয়াছে বলিয়াই তাদের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতা হইবে না, এটা কোন কাজের কথা নয়। মার্কিন মুলুক ও ইংলণ্ড লড়াই করিয়াই পৃথক হইয়াছিল। লড়াইর সে তিক্ততা, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি, প্রতিশোধের স্পৃহা, ক্ষয়ক্ষতির ধ্বংস লীলা, কোনোটাই ইংগ মার্কিন মৈত্রী ও সহযোগিতায় বাধা দিতে পারে নাই। যুদ্ধশেষে তারা এমন মিত্র হইয়াছে যে দুই শ বছরের সুদীর্ঘ মুদ্দতও সে-মৈত্রী ও সহযোগিতায় ফাটল ধরাইতে পারে নাই। পাক-বাংলাদেশ সম্পর্ক তেমন হইতে পারে।