১. কাল তামামির সময় আসে নাই
পাঠক, আগের অধ্যায়ে যে কালতামামি পড়িয়াছেন, এটা কিন্তু তেমন কালতামামি না। আগের-আগের কালতামামিগুলি ছিল কালের বা যুগের হিসাব নিকাশ। আর এখানে যে যুগের কথা বলিতেছি, তার হিসাব-নিকাশ করিবার সময় আজও আসেনাই। এ যুগের দুইটা স্তর। আসলে একই যুগের এপিঠ-ওপিঠ। এক স্তরে লাহোর প্রস্তাবের পঁচিশ-বছর স্থায়ী বিট্রেয়ালের অবসান; অপর স্তরে নয়া যুগের শুরু। লাহোর প্রস্তাবের বিট্রেয়াল-সম্পর্কে ইতিপূর্বেই অনেক আলোচনা হইয়াছে। আমিও করিয়াছি। আমার সম্প্রতি-প্রকাশিত বাংলা বই ‘শেরে বাংলা হইতে বংগবন্ধু’ ও ইংরাজি বই End of a Betrayal and Restoration of Lahore Resolution এ সম্ভাব্য সকল দিক হইতে এই স্তরের বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। এই অধ্যায়ে সে সবের পুনরুক্তি করা উচিৎ হইবে না। এইটুকু বলিলেই যখে হইবে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাহোর-প্রস্তাবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া আর বেশ কিছু নয়।
আর এই যুগের অপর পৃষ্ঠাকে আমাদের জাতীয় জীবনের নয়া যমানা বলিয়াছি। এটা আমাদের স্বাধীনতার যুগ। এ যুগ রু হইয়াছে মাত্র। এই স্বাধীনতারই আবার অনেক দিক। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কৃষ্টিক বা সাহিত্যিক স্বাধীনতা, জাতীয় ব্যক্তিত্বের সম্যক বিকাশ ও পরিপূর্ণতা লাভের স্বাধীনতা এই সবের সমবিত একাণ ও বিকাশের নামই স্বাধীনতা। লাহোর প্রস্তাবের বিট্রেয়ালটা প্রমাণিত হইতে এবং সে বিক্রয়ালের অবসান ঘটানোর মত নিগেটিভ কাজটা করিতেই দীর্ঘ পঁচিশ বর লাগিয়াছে। লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও রূপায়নের মত পঘিটিত কাজ করিতে তার চেয়ে দীর্ঘতর সময় লাগিলেও তাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। অথচ আমাদের স্বাধীনতার কাজ মাত্র দুই বছর সমাপ্ত হইতেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি আমরা অনেক করিয়াছি। কিন্তু ভাল কাজও কম করি নাই। কল্পনাতীত ও আশাতীত অল্প সমক্সের মধ্যে আমরা দেশকে একটি শাসনতান্ত্রিক সংবিধান দিয়াছি। পার্লামেন্টারি শাসন পদ্ধতিকে দৃঢ়-ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আঠার বছর বয়কে তোটাধিকার দিয়া আমরা গণকে গণের দিকে প্রসারিত করিয়াছি। দুই বছরের ইতিহাসটা কম কৃতিত্বের রেকর্ড নয়। কিন্তু এটা শুরু মাত্র। সমস্যা আমাদের অনেক বলিয়াই দায়িত্বও আমাদের বেশী। করণীয় আমাদের অনেক। আমাদের গরিকের সংসার। গরিবের সংসার বলিয়াই সমস্যাও আমাদের অনেক। সংখ্যায়নয়। বিবৃতি ও গভীরতায়ও। শুধু ভিতরের নয়, বাহিরেরও। শুধু দেহের নয়, মনেরও। শুধু পায়ের নয়, মাথারও। শুধু চলার নয়, চিন্তারও। এমন সর্বব্যাপী সমস্যার সমাধান কেউ দুই বছরে আশা করিতে পারেন না। ঠিক পথে চলিয়াছি কি না, সেটাই আমাদের বিচার্য। যদি তা করিয়া থাকি, তবে ওয়েল বিগান হা ডান। এই ওয়েল বিগানের পথে যদি কোনও বাধা, বিভ্রান্তি বা কন্টক সৃষ্টি হইয়া থাকে, তবে সেটা অবশ্যই সর্বাগ্রে দূর করিতে হইবে। এমন কয়টি বিভ্রান্তি সত্যই সৃষ্টি হইয়াছে। সেগুলিকে কন্টক বলা যায়। সে কয়টির দিকে দেশবাসীর, রাষ্ট্রনায়কদের এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এই কালতামামির উদ্দেশ্য।
২. জাতীয় ক্ষতিকর বিভ্রান্তি
এইসব বিভ্রান্তির মধ্যে প্রধান এইঃ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তান ভাংগিয়া গিয়াছে; ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে।‘ এটা সাংঘাতিক মারাত্মক বিভ্রান্তি। অন্যান্য ক্ষতিকর বিভ্রান্তি মোটামুটি এটা হইতেই উদ্ভূত। এই বিভ্রান্তির সর্বপ্রথম ও প্রত্যক্ষ কুফল এই যে, এতে ভারত সরকারকে নাহক ও মিথ্যা বদনাম শোহইতে হইতেছে। পাকিস্তান যদি ভাংগিয়া থাকে, তবে ভারতই ভাংগিয়াছে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাসিলে ভারত সরকার সক্রিয় ও সামরিক সাহায্য করিয়াছেন। ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ যদি মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া থাকে, তবে ‘৪৭ সালের ভারত বাটোয়ারার আর কোনও জাষ্টিফিকেশন থাকিতেছে না। কোরিয়া ভিয়েৎনাম ও জার্মানির মতই ভারতেরও পুনর্যোজনের চেষ্টা চলিতে পারে। ভারতবর্ষের বেলা সে কাজে বিলম্ব ঘটিলেও বাংলার ব্যাপারে বিশ্বের কোন কারণ নাই। উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি স্থাপনের পক্ষে এই ধরনের কথা ও চিন্তা যে কত মারাত্মক, বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা তা না বুঝিলেও ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়করা তা বুঝিয়াছেন। তাই উভয় পক্ষই কালবিলম্ব না করিয়া এ বিষধর সাপের মাথা ভাংগিয়া দিয়াছেন। ভারত সরকার এক মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া পশ্চিম প্রান্তে একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করিয়া পাকিস্তানের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়াইয়াছেন। ওদিককার দখলিত ভূমি ও যুদ্ধবন্দী ছাড়িয়া দিয়াছেন। আর এদিকে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছেন। বাংলাদেশের মাটি হইতে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করিয়াছেন। বাংলাদেশের সাথে মৈত্রী ও বাণিজ্য চুক্তি করিয়াছেন। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মেম্বর করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এদিকে আমাদের প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সুযোগেই ঘোষণা করিয়াছেন : বৃহত্তর বাংলা গঠনের কোন ইচ্ছা আমার নাই। পশ্চিমবংগ ভারতেই থাকিবে। আমার দেশের বর্তমান চৌহদি লইয়াই আমি সন্তুষ্ট। অন্যের এক ইঞ্চি জমিও আমি চাইনা।