কিন্তু আমি দেখিয়া খুবই আতংকিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপযিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না। তাঁরা যেন নীতি হিসাবেই এই পন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন। নির্বাচনের ফলে অপযিশন একরূপ শূন্যের কোঠায় পৌঁছিয়াছিল। কয়েকটি দলের এবং নির্দলীয় মেম্বর মিলিয়া শেষ পর্যন্ত তাঁরা হইলেন মাত্র ৮ জন। অপযিশন ছাড়া পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই এই ছিন্ন-ভিন্ন অপযিশনকে লালন করিয়া আমাদের আইন সভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টের রূপ ও প্রাণ দিবার চেষ্টা শাসক দলেরই অবশ্য কর্তব্য ছিল। শাসক দল সে কর্তব্য পালন ত করিলেনই না, ভিন্ন-ভিন্ন দলের মেম্বররা নিজেরাই যখন একত্রিত হইয়া জনাব আতাউর রহমানকে লিডার নির্বাচন করিলেন, তখনও সরকারী দল তাঁকে লিডার-অব-দি অপযিশন স্বীকার করিলেন না। নির্বাচনের পরে ন মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হইয়াছে। এর মধ্যে পার্লামেন্টের দুই-দুইটা অধিবেশনও হইয়া গিয়াছে। তবু আমাদের পার্লামেন্টে কোন লিডার-অব-দি-অপযিশন নাই। তার মানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতি-অনুসারে আমাদের আইন-পরিষদ আজও পার্লামেন্ট হয় নাই। যা হইয়াছে, সেটা আসলে একদলীয় আইনসভা। এটা নিশ্চিতরূপে অশুভ। প্রশ্ন জাগে আমরা কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হইতেছি? কিন্তু তা বিশ্বাস করিতে মন চায় না। কারণ এটা ও আওয়ামী লীগের বিঘোধিত মূলনীতি-বিরোধীই নয়, তার নির্বাচনী প্রতীক নৌকারও তাৎপর্য-বিরোধী। নৌকা চালাইতে যেমন দুই কাতারের দাড়ী লাগে, গণতন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাই লাগে। যদি কোনও দিন নৌকার সব দাঁড়ি এক পাশে দাঁড় টানিতে শুরু করে, তবে সেদিন নৌকা আর যানবাহন থাকিবে না। হইবে সেটা মিউযিয়মের দর্শনীয় বস্তু।
৬. ভোটারদের কর্তব্য ও দায়িত্ব
এই অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব যতটা দায়ী, আমাদের ভোটারদের, জনগণের, দায়িত্ব তার চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের ভোটাররা রাজনীতিক জ্ঞানে সচেতন বলিয়া একটা কথা আছে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে তাঁদের আরও সচেতন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ভোট দেওয়া উচিৎ ছিল। গণ-ঐক্যের ভাবাবেগে এই নির্বাচনে সকলের একই পার্টিকে ভোট দেওয়া যে পরিণামে ভোটারদের জন্যই ক্ষতিকর, এটা তাঁদের বোঝা উচিৎছিল। একদলীয় শাসনই পরিণামে ব্যক্তি-স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। তেমন শাসনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় এটা ধরিয়া নিলেও জাতির মানস ও মননশীলতার যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। ভোটারদেরে এ কথা বুঝাইয়া দিবার লোকের অভাব ছিল না। বিরোধী দলের প্রার্থী ও নেতারা ত বুঝাইয়াছিলেনই আমার মত নিরপেক্ষ রাজনৈতিক হরিঠাকুরও এটা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমি ইত্তেফাকে লিখিয়াছিলামঃ ‘৭০ সালের নৌকা ও এবারকার নৌকার মৌলিক পার্থক্য আছে। ৭০ সালেরটা ছিল চড়িবার নৌকা। এবারকারটা চালাইবার নৌকা। নৌকা চালাইতে ডাইনে-বাঁয়ে দুই সারি দাঁড়ি লাগে। নৌকার হাইল ধরিবেন শেখ মুজিব নিজেই ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ী হইবেন দুই কাতারের। সব দাঁড়ী একদিক হইতে দাঁড় টানিলে নৌকা সামনে চলিবার বদলে ঘুরপাক খাইয়া ডুবিতে পারে।’ এই পার্টিকে সব ভোট দেওয়ার বিরুদ্ধে এরচেয়ে বড় হুশিয়ারি আর কি হইতে পারে? হুশিয়ারি ছাড়া ভোটারদের সমর্থনে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার প্রমাণস্বরূপ, অনেক কথা বলিয়াছিলাম। এবারকার নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেক রাষ্ট্র-দার্শনিক ভবিষ্যত্বাণী করিয়াছিলেন : বাংলাদেশের ভোটাররা বরাবর এক বাক্সে ভোট দেন; আর তাঁরা বরাবর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন। আমি ঐ সব রাজনৈতিক গণকদের কথার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তাঁরা ‘৪৬ সাল, ‘৫৪ সাল ও ‘৭০ সালের নির্বাচনের নযির দিয়া তাঁদের কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি তাঁদের কথার প্রতিবাদে বলিয়াছিলাম, ঐ তিন সালের কোনওটাই সরকার গঠনের মামুলি নির্বাচন ছিল না। সেগুলি ছিল মূলনীতি নির্ধারণের ভোট। ‘৪৬ সালেরটা পাকিস্তান বনাম অখণ্ড ভারতের ভোট, ৫৪ সালের একুশ দফা ও ৭০ সালের ছয় দফা উভয়টাই ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বনাম স্ট্রংসেন্টারের ভোট। ঐ সব নির্বাচনে এক বাক্সে ভোট না দিয়া উপায় ছিল না। কারণ উভয়টাই ছিল জনগণের দাবি। কিন্তু ‘৭৩ সালের নির্বাচনে ঐ ধরনের কোন মূলনীতি নির্ধারণের প্রশ্ন ছিল না। ওটা ছিল নিতান্তই সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনের প্রশ্ন। অবশ্য কোন-কোনও আওয়ামী নেতা এই নির্বাচনকে সদ্য রচিত সংবিধানের র্যাটিফিকেশনের ভোট আখ্যায়িত করিয়াছিলেন। তাতেও ভোটারদের কর্তব্যের কোনও ব্যত্যুবা ব্যতিক্রম ঘটিবার কথা ছিল না। আওয়ামী লীগ নিরংকুশ মেজরিটি পাইলেই তাঁরা সরকারও গঠন করিতে পারিতেন; সংবিধানটাও কার্যতঃ গ্যাটিফাইড় হইয়া যাইত। এক বাক্সে সব ভোট পড়িবার, প্রকারান্তরে অপযিশন ক্রাশ করিয়া পার্লামেন্টকে ঠুটো জগন্নাথ’ করিবার, কোনও দরকার ছিল না। বাংলাদেশের ভোটাররা এবার তাই করিয়াছেন। নির্বাচিত সরকাররা যে সব ভুল করেন, গণতন্ত্রের বিচারে সে সব ভুলের জন্যও ভোটাররাই দায়ী। আর ভোটাররা নিজেরা যে ভুল করেন, তার জন্য দায়িত্ব বহন ও ফলভোগ তাঁদের করিতেই হইবে।
৩২.১০ কালতামামি
কালতামামি
উপাধ্যায় দশ