আমি কিন্তু ঘরে বসিয়াই স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিলাম, আওয়ামী লীগের ডর ও বিরোধী দলের আশা দুইটাই অমূলক। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নির মেজরিটিই পাইবে। আওয়ামী-বন্ধুদের কাছে মুখে-মুখে যেমন একথা বলিতেছিলাম, কাগযেও তেমনি লিখিতেছিলাম : আওয়ামী লীগ শুধু আসন্ন নির্বাচনেই নয় আগামী পঁচিশ বছরের নির্বাচনে জিতিবে এবং দেশ শাসন করিবে। আমি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ শাসনকে ভারতের কংগ্রেসের পঁচিশ বছরের আমলের সাথে তুলনা করিয়াছিলাম। লিখিয়াছিলাম, নেহরু-নেতৃত্বের কংগ্রেসের মত মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় থাকিলেই এটা অতি সহজ হইবে।
এই বিশ্বাসে আমি আওয়ামী-নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়াছিলাম, বিরোধী পক্ষের অন্ততঃ জন-পঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিতে দেওয়া উচিৎ। তাতে পার্লামেন্টে একটি সুবিবেচক গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী অপযিশন দল গড়িয়া উঠিবে।
আমার পরামর্শে কেউ কান দিলেন না। বিরোধী দলসমূহের ঐ নিশ্চিত বিজয় সম্ভাবনার উল্লাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে অমন উদার হওয়াটা, বোধ হয়, সম্ভবও ছিল না। রেডিও-টেলিভিশনে অপযিশন নেতাদের বক্তৃতা দূরের কথা, যান বাহনের অভাবে তাঁরা ঠিকমত প্রচার চালাইতেও পারিলেন না। পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব হেলিকপ্টারে দেশময় ঘূর্ণীঝড় টুওর করিতে লাগিলেন। মন্ত্রীরাও সরকারী যানবাহনের সুবিধা নিলেন।
অপযিশনের স্বপ্ন টুটিল। মওলানা সাহেব অসুস্থ হইয়া হাসপাতালে ভর্তি হইলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে হাসপাতালে দেখা করিয়া তাঁর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করিয়া সর্বশেষ তুরুফ মারিলেন।
নির্বাচনে অপযিশনেরভরাডুবি হইল।
৪. নির্বাচনের ফল ও কুফল
৭ মার্চ নির্বাচন হইল। ৩০০ সীটের মধ্যে ২৯২টি আওয়ামী লীগ ও মাত্র ৭টি অপরপক্ষ পাইল। একটি সীটে একজন প্রার্থী মোটর দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তার নির্বাচন পরে হইল। সেটিও আওয়ামী লীগই পাইল। বিরোধী পরে ৭টির মধ্যে জাসদের ৩, জাতীয় লীগের ১ ও নির্দলীয় ৩ জন নির্বাচিত হইলেন। দুইটি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি কোন সীট পাইল না। জাতীয় লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব আতাউর রহমান খাঁ নির্বাচিত হইয়া তাঁর পার্টির নামটা জীবন্ত রাখিলেন। পরে নির্বাচিত মেম্বারদের ভোটে যে ১৫টি মহিলা আসনের নির্বাচন হইল তার সব কয়টি অবশ্যই আওয়ামী লীগই পাইল। এইভাবে পার্লামেন্টের ৩১৫ জন মেম্বরের মধ্যে ৩০৮ জনই হইলেন আওয়ামী লীগের। মাত্র ৭ জন হইলেন অপযিশন।
এতে আওয়ামী-নেতৃত্বের আরও বেশি সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সে কর্তব্য অবশ্য শুরু হইয়াছিল আগেই। নির্বাচন চলাকালেই। গোড়ার দিকে পরিস্থিতি সম্পর্কে উভয়পক্ষের ভ্রান্ত ধারণা থাকার দরুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব উদার হইতে পারেন নাই। কিন্তু নমিনেশন পেপার বাছাইর দিনেই আওয়ামী লীগের বিপুল জয় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। শেখ মুজিব দুটি আসন হইতেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইলেন। আওয়ামী লীগের আরও ৭ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইলেন। এই সময়ে আওয়ামী নেতৃত্বের উদার হওয়ার কোনও অসুবিধা বা রিস্ক ছিল না। বিরোধী দলসমূহের প্রার্থীদের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান খাঁ, প্রফেসর মোত্মাফফর আহমদ, ডাঃ আলিমুর রাযী, জনাব নূরুর রহমান, রাজশাহীর মিঃ মুজিবুর রহমান, জনাব অলি আহাদ, মিঃ সলিমুল হক খান মিকী, মিঃ আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, মিঃ যিলুর রহিম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মিঃ বলুস-সাত্তার প্রভৃতি জন-পঁচিশেক অভিজ্ঞ সুবক্তা পার্লামেন্টারিয়ানকে জয়ী হইতে দেওয়া আওয়ামী লীগের ভালর জন্যই উচিৎ ছিল।
তিনশ’ পনর সদস্যের গার্লমেন্টে জনা-পঁচিশেক অপযিশন মেম্বর থাকিলে সরকারী দলের কোনই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ঐ সব অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান অপযিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত। তাঁদের বক্তৃতা বাগ্মিতায় পার্লামেন্ট প্রাণবন্ত, দর্শনীয় ও উপভোগ্য হইত। সরকারী দলও তাতে উপকৃত হইতেন। তাঁদের গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে বক্তৃতা দিতে গিয়া সরকারী দলের মেম্বাররা নিজেরা ভাল-ভাল দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হইয়া উঠিতেন। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এ সব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।
৫. আওয়ামী-নেতৃত্বের ভ্রান্ত-নীতি
কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য এই যে শেখ মুজিব এই উদারতার পথে না গিয়া উল্টা পথ ধরিলেন। এই সব প্রবীন ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিলেন। জনাব আতাউর রহমানকে হারাইবার জন্য আওয়ামী-নেতৃত্ব যে পন্থা অবলম্বন করিলেন, সেটাকে কিছুতেই নির্বাচন প্রচারণার সুস্থ ও স্বাভাবিক নীতি বলা যায় না। বরঞ্চ আমার বিবেচনায় সেটা ছিল খোদ আওয়ামী লীগের জন্যই আত্মঘাতী। তাঁর মত ধীরস্থির অভিজ্ঞ গঠনাত্মক চিন্তাবিদ পার্লামেন্টের অপযিশন বেঞ্চের শুধু শোভা বর্ধনই করেন না, সরকারকে গঠনমূলক উপদেশ দিয়া এবং গোটা অপযিশনকে পার্লামেন্টারি রীতি-কানুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিয়া পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকেন। এমন একজন ব্যক্তিকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার সর্বাত্মক চেষ্টা আওয়ামী নেতৃত্ব কেন করিলেন, তা আমি আজও বুঝিতে পারি নাই। কারণ এমন চেষ্টা যে মনোতাবের প্রকাশ, সে মনোভাব পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সাফল্যের অনুকূল নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মত অভিজ্ঞ ও প্রবীণ পার্লামেন্টারি নেতা কিছুতেই এমন আত্মঘাতী নীতির সমর্থক হইতে পারেন না। যদি খোদা-না-খাস্তা শেখ মুজিব কোনও দিন তেমন মনোভাবে প্রভাবিত হন, তবে সেটা হইবে দেশের জন্য চরম অশুভ মুহূর্ত।