২. নির্বাচনে আশা-প্রত্যাশা
এই নির্বাচনটা ছিল বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রথম পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগই দেশকে এই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সংবিধান দিয়াছে। হঠাৎ দেয় নাই; কারো চাপে পড়িয়া দেয় নাই। আওয়ামী লীগ আজন্ম পালমেন্টারি পদ্ধতির দৃঢ় সমর্থক। সেই কারণেই তাঁরা দেশকে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা দিয়াছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পার্লামেন্টারি পদ্ধতিই বাংলাদেশের জন্য একমাত্র উপযুক্ত পন্থা।
কাজেই আসন্ন নির্বাচনে যাতে পালামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপিত হয়, সে চেষ্টা আওয়ামী লীগের করা উচিত ছিল। তাঁদের বোঝা উচিৎ ছিল, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির অসাফল্য কার্যতঃ আওয়ামী লীগেরই অসাফল্য রূপে গণ্য হইবে।
পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন মানে বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক ভাল মানুষ নির্বাচিত হউন, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। সে দৃষ্টিতে যথেষ্ট উদারতা ও সহিষ্ণুতা আবশ্যক। রাজনৈতিক হরিঠাকুর হিসাবে আমি আওয়ামী নেতাদের কাউকে কাউকে আগে হইতেই উপদেশ দিয়াছিলাম। মুখে-মুখেও দিয়াছিলাম, ইত্তেফাকে একাধিক প্রবন্ধ লিখিয়াও তেমন উপদেশ দিয়াছিলাম। আমি এ বিষয়ে বিশেষ ন্যর রাখিবার উপদেশ দেওয়া দরকার মনে করিয়াছিলাম দুইটি কারণে। প্রথমতঃ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সংগ্রামের মধ্য দিয়া দেশ স্বাধীন হইয়াছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার মধ্যে গোটা জাতির একটা ভাবাবেগ মিশ্রিত আছে। দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগ নৌকাকেই তাদের নির্বাচনী প্রতীক করিয়াছেন। নৌকা-প্রতাঁকের সাথে বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে ভাবাবেগের ঐতিহ্য আছে। ‘৭০ সালের নির্বাচনে এই প্রতীক লইয়াই আওয়ামী লীগ অমন বিপুল জয়লাভ করিয়াছিল। তার আগে শেরে-বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ঐ নৌকা প্রতীক দিয়াই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করিয়াছিল।
কাজেই নির্বাচনে সরকারী দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলের প্রতি উদার হওয়া উচিৎ ছিল। উদার হইতে তাঁরা রাযীও ছিলেন। রেডিও-টেলিভিশনে বিরোধী দল সমূহের নেতাদের বক্তৃতার ব্যবস্থা করিতেও তাঁদের আপত্তি ছিল না।
কিন্তু পর-পর কতকগুলি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য আওয়ামী নেতারা কঠিন হইয়া পড়িলেন।
সরকারী দল হিসাবে দেশের সমস্ত দুর্দশা-দূর্ভাগ্যের জন্য সরকার দায়ী, এই মনোভাব হইতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারাইবার যথেষ্ট কারণ ত ছিলই, তার উপর বছরের শুরুতেই ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারিতেই ভিয়েতনাম উপলক্ষে ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি চালনার দরুন দুইজন ছাত্র নিহত ও অনেক আহত হয়। পরদিন দেশব্যাপী হরতাল হয়। ফলে দৃষ্টতঃই আওয়ামী লীগ ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারায়৷ মোফর ন্যাপ ও ছাত্র-ইউনিয়নই সরকার-বিরোধী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেছিল। এই কারণেই ছাত্রলীগের লোকেরা ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের অফিস পোড়াইয়া দিয়াছে বলিয়া খবর বাহির হয়। তাতেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হয়। এই অজনপ্রিয়তা প্রসারিত হয় মফস্বলে সরকারের বর্ডার প্যাক্ট ও পাটনীতি উপলক্ষ করিয়া।
৩. হিসাবে ভুল
এই দৃশ্যমান অজনপ্রিয়তার অতিরঞ্জিত ওভার এস্টিমেট করিলেন উভয় পক্ষই। আওয়ামী লীগাররা ঘাবড়াইলেন। আর বিরোধী পক্ষ উল্লসিত হইলেন। পার্লামেন্টারি রাজনীতির খাতিরে আওয়ামী নেতৃত্ব নির্বাচনে কিছুটা উদার হওয়ার যে ইচ্ছা করিতেছিলেন, পরিস্থিতির এই অতিরঞ্জিত ভুল অর্থের ফলে সে মতের পরিবর্তন হইল। অপর দিকে বিরোধী দল সমূহের মধ্যে একটা যুক্তফ্রন্ট গড়িয়া তুলিবার যে চেষ্টা হইতেছিল তা ভণ্ডুল হইয়া গেল। ভাবখানা এই যে আওয়ামী লীগ যেখানে এমনিতেই হারিয়া যাইতেছে, সেখানে বিরোধী পক্ষের ঐক্য ফ্রন্ট করিবার দরকারটা কি? বিদ্ৰোধী দল সমূহের আস্থা ও জয়ের আশা এমন উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল যে, একুশে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিশেষ করিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবার জন্য সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভা করিতেছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বদলীয় বিরোধী নেতা মওলানা ভাসানী সাহেব পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সরকার-বিরোধী বক্তৃতা করিতেছিলেন। একই সময়ে এই দুই সভায় দুই জনপ্রিয় নেতা বক্তৃতা করায় কোন সভায় বেশী লোক সমাগম হইয়াছিল, তা লইয়া তক পর্যন্ত বাধিয়াছিল।
এমন অবস্থায় একদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে আরও বেশী জোর দিলেন। অপর দিকে বিরোধী দলসমূহের কোন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হইবেন, তাই লইয়া তাঁরা বিতর্কে অবতীর্ণ হইলেন। স্মরণযোগ্য যে, এই সময়ে কথা উঠিয়াছিল স্বয়ং মওলানা ভাসানীও নির্বাচনে দাঁড়াইবেন। বিরোধী দল নির্বাচনে জয়লাভ করিলে জনাব আতাউর রহমান খাই প্রধানমন্ত্রী হইবেন, অধিকাংশ দলের মতে এটা ঠিক হইয়াই ছিল। আওয়ামী লীগের কল্পিত আপপুলারিটি যখন বিরোধী দলসমূহের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল, তখন মওলানা সাহেবের দলের এক নেতা প্রকাশ্যভাবেই বলিয়া ফেলিলেন যে মওলানা সাহেবের জনপ্রিয়তার সুযোগ লইয়া যেখানে বিরোধী দল নির্বাচনে জিতিতেছে, সেখানে মওলানা সাহেব প্রধানমন্ত্রী না হইয়া অপরে প্রধানন্ত্রী হইবেন কেন?