পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনার সময় আমি বলিয়াছিলামঃ পাকিস্তানে ইসলাম রক্ষার চেষ্টা না করিয়া গণতন্ত্র রক্ষার ব্যবস্থা করুন। গণতন্ত্রই ধর্মের গ্যারান্টি। বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাদেরও আমি বলিয়াছিলাম : বাংলাদেশের সমাজবাদের কোনও বিপদ নাই, যত বিপদ গণতন্ত্রের। গণতন্ত্রকে রোগমুক্ত করুন, সমাজবাদ আপনি সুস্থ হইয়া উঠিবে। পাকিস্তানের নেতাদের মতই আমাদের নেতারাও এই ‘বৃদ্ধের বচন’ শুনেন নাই। ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করিবার চেষ্টায় পাকিস্তানের নেতারা তার অনিষ্ট করিয়াছেন। আমাদের নেতারা ‘সমাজতন্ত্র’কে রাজনৈতিক হাতিয়ার করিবার চেষ্টায় আমাদের রাষ্ট্রের তেমন কোনও অনিষ্ট করিয়া না বসেন, সেটাই আমার দুশ্চিন্তা। আমাদের নেতৃবৃন্দ ও তরুণদের মধ্যে এক শক্তিশালী গোষ্ঠী আছেন, যাঁরা মনে করেন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এক সংগে চলিতে পারে না। পাকিস্তানের চিন্তা-নায়কদের মধ্যেও একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিলেন যাঁরা বলিতেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র এক সংগে চলিতে পারে না। বাংলাদেশের কোনো-কোনো প্রভাবশালী নেতা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়াছেন : ‘যদি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এক সাথে চলিতে নাই পারে, তবে আমরা গণতন্ত্র ছাড়িয়া সমাজতন্ত্র ধরিব।‘ অবশ্য এ কথার জবাবে কোনও-কোনও নেতা এমন কথাও বলিয়াছেন : ‘যদি দুইটা এক সংগে নাই চলে তবে আমরা সমাজন্ত্র ছাড়িয়া গণতন্ত্রই ধরিব।‘ জনগণের উপর নির্ভর করিলে এই ‘ধরা-ছাড়ার’ কোনও প্রয়োজন হইবে না।
কিন্তু বিপদ এই যে আমরা যারা বিপ্লবে বিশ্বাস করি, তারা জনগণের উপর নির্ভর করি না। মাশাআল্লাহ, আমাদের মধ্যে বিপ্লবীর অভাব নাই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপ্লব ও আমাদের সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ বলার লোক নেতাদের মধ্যেই অনেক আছেন। তাঁরা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লড়াই-এর বেলা যদি ‘বিপ্লব’ করিয়া বসেন, তবে গণতন্ত্রের পরাজয় অবধারিত। বীর জনগণকে জিগার্সা না করিয়াই যদি তেমন বিপ্লব হইয়া যায়, তবু সেটাকে বীর জনগণের অভিপ্রায় বলিয়াই চালান হইবে। বলা হইবে পশ্চিমা গণতন্ত্র বুর্জোয়া গণতন্ত্র। তার চেয়ে বিপ্লবী সর্বহারার গণতন্ত্র অনেক ভাল।
আমাদের সংবিধানে তেমন বিপদের সংকেত অনেক আছে। তার মধ্যে প্রধানটি এই যে, নির্বাচিত কোনও সদস্য দলত্যাগ করিলে বা দল হইতে বহিষ্কৃত হইলে তাঁর মেম্বরগিরি আপনা-আপনি চলিয়া যাইবে। এ কথার তাৎপর্য এই যে, ভোটারদের নির্বাচনটা কিছু নয়, পার্টির মনোনয়নটাই বড়। এটা একদলীয় শাসন ও পার্টি ডিক্টেটরশিপের পূর্ব লক্ষণ। পার্টি ডিক্টেটরশিপই পরিণামে ব্যক্তি-ডিক্টেটরশিপে পরিণত হয়। গণতন্ত্রের বিপদ এখানেই।
বিপদ আরও আছে। গণতন্ত্রকে যখন বিশেষণে বিশেষিত করা হয়, তখনই গণতন্ত্রের অসুখ শুরু হয়। পাকিস্তানে ও দুনিয়ার অন্যত্র পাঠকগণ তা দেখিয়াছেন। তেমনি রাষ্ট্রনামের প্রজাতন্ত্রের যদি কোনও বিশেষণ দেওয়া হয়, তখনই সেটাকে ব্যতিক্রম মনে করিতে হইবে। প্রজাতন্ত্র মানেই জনগণের শাসন। সেটাকে যদি গণপ্রজাতন্ত্র বলিয়া ডাবল গ্যারান্টি দেওয়া হয়, তবে সেটা ব্যাসিক ডেমোক্র্যাসির রূপ ধারণ করিলে বিস্ময়ের কিছু থাকিবে না।
৩২.০৯ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন
উপাধ্যায় নয়
১. জন-যুদ্ধের গণতান্ত্রিক রূপ
স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে দেশের কনস্টিটিউশন রচনা সমাপ্ত করা বা নয়া কনস্টিটিউশন প্রবর্তনের তিন মাসের মধ্যে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন দেওয়া গণতান্ত্রিক দুনিয়ার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত স্থাপনের সকল কৃতিত্ব আওয়ামী নেতৃত্বের। সব প্রশংসা তাঁদেরই। স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন-যুদ্ধেরই এটা ছিল গণতান্ত্রিকরূপ।
নয়া রাষ্ট্র ও নতুন জাতির এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যে বিপুল উল্লাস, উদ্যম ও উদ্দীপনা দেখা দিয়াছিল, সেটাও ছিল সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী। আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় বিধান আঠার বছর-বয়স্কদের ভোটাধিকার। এ বিধানের জন্য আমরা ন্যায়তঃই গর্ববোধ করিতে পারি। আফ্রো-এশিয়ান সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ভোটাধিকারকে এমন গণ-ভিত্তিক করিয়াছে।
শুধু আফ্রো-এশিয়ান রাষ্ট্রেই নয়, বহু প্রবীণ-প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও আজ পর্যন্ত ভোটাধিকারকে এমনভাবে তরুণদের স্তরে প্রসারিত করা হয় নাই। যে সব সত্য ও উন্নত দেশে শিক্ষার প্রসার প্রায় সার্বজনীন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমরা আফ্রো এশিয়ান দেশের যে-যেখানে শিক্ষিতের হার মাত্র শতকরা বিশ, যে-সব দেশের শতকরা আশিজনই নিরক্ষর, সে সব দেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের অধিকাংশই একুশ বছরের কম বয়স্ক। এসব দেশের ভোটাধিকারকে একুশে সীমাবদ্ধ করিলে শিক্ষিত সমাজের এক বিরাট অংশকেই ভোটাধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এ ব্যবস্থা আরও ঘোরর অন্যায় এই জন্য যে আমাদের দেশের সকলপ্রকার জাতীয় অধিকারের আন্দোলনে ছাত্র-তরুণরাই পয়লা কাতারের সৈনিক হিসাবে ত্যাগ স্বীকার করিয়া আসিয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পরে নাবালকত্বের অজুহাতে তাঁদেরই ভোটাধিকার হইতে, তার মানে রাষ্ট্রপরিচালক নির্বাচনের অধিকার হইতে, বঞ্চিত রাখা ন্যায়তও অসংগত, রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক হইতেও ভ্রান্তনীতি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রথম সুযোগেই এই অন্যায় ও ভ্রান্ত নীতির অবসান করিয়াছেন বলিয়া তাঁরা সারা দেশবাসীর বিশেষতঃ তরুণ-সমাজের, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।