পক্ষান্তরে কোন-কোন মুসলিম কাগযে খবর ছাপা হইল : কংগ্রেসীদের সম্মিলনী ব্যর্থ হইয়াছে। মুসলিম জনতা সম্মিলনীর প্যাণ্ডাল দখল করিয়াছে। সেই প্যাণ্ডালেই কংগ্রেস-বিরোধী প্রস্তাব পাস হইয়াছে এবং মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার পুনরাবৃত্তি করা হইয়াছে।
আমি মনে-মনে হাসিলাম। বুঝিলাম এ ধরনের কাগযী আন্দোলন করিয়া কোনও লাভ হইবে না। প্রজা-সমিতিকে সত্য-সত্যই প্রজাদের প্রতিষ্ঠানরূপে গড়িয়া ভোলার কাজে মন দিলাম।
০৫. ময়মনসিংহে সংগঠন
ময়মনসিংহে সংগঠন
পাঁচই অধ্যায়
১. বিচিত্র সাম্প্রদায়িকতা
অতঃপর আমি শহর ফেলিয়া মফস্বলের দিকে মনোযোগ দিলাম। বস্তুতঃ বাধ্য হইয়াই আমি তা করিয়াছিলাম। মুসলিম শিক্ষিত সমাজ সাধারণভাবেই এই সময়ে কংগ্রেস-বিরোধী, হিন্দু-বিরোধী, এমনকি দেশের স্বাধীনতাবিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। ত্রিশ-বত্রিশ জন মুসলমান উকিলের মধ্যে জনাতিনেক, পঞ্চাশ জন মোখতারের মধ্যে জন চারেক, শতাধিক মুসলিম ব্যবসায়ীর মধ্যে দু-এক জন ছাড়া আর সবাই কংগ্রেস ও হিন্দুদের নামে চটা। অসাম্প্রদায়িক কথা তাঁরা শুনিতেই রাযী না।
অথচ এদের অধিকাংশের সম্প্রদায়-প্রীতি ছিল নিতান্তই অদ্ভুত। এরা মুখে-মুখে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে হিন্দু ও কংগ্রেসের নাম শুনিতে পারিতেন না। কিন্তু ওকালতি ও মোখতারি ব্যবসায়ের বেলা হিন্দু সিনিয়র উকিল-মোখতারদেরেই কেস দিতেন এবং তাঁদের চেম্বারেই দেন-দরবারে কাল কাটাইতেন। কাপড়-চোপড় কিনিবার সময় এঁরা একমাত্র মুসলিম দোকান ‘মৌলবীর দোকান’ বাদ দিয়া ‘বংগলক্ষ্মী’ আর্য ভাণ্ডার’ প্রভৃতি হিন্দুর দোকান হইতে খরিদ করিতেন। হেতু জিগাসা করিলে বলিতেন,’ মৌলবীর দোকানে দাম অন্ততঃ টাকায় দু’পয়সা বেশি নেয়। পক্ষান্তরে আমরা তথাকথিত ‘হিন্দুর দালাল’ কংগ্রেসী মুসলমানরা খদ্দর কিনিবার সময়ও মুসলমানের কোনও খদ্দরের দোকান আছে কিনা খোঁজ লইতাম এবং ‘মৌলবীর দোকান’ ও অন্যান্য মুসলমান ব্যবসায়ীদেরে দোকানে খদ্দর রাখিবার পরামর্শ দিতাম।
এই সময় বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি সার আঃ রহিম সেক্রেটারি মৌঃ মুজিবুর রহমান। কাজেই মুসলমানদের বিশেষ আকর্ষণ স্বরূপ আমি ঐ মুসলিম লীগের জিলা শাখা প্রতিষ্ঠা করিলাম। আমি নিজে নামে মাত্র প্রেসিডেন্ট হইয়া প্রবীণ উকিল মৌঃ আবদুস সোবহানকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মৌঃ মুজিবুর রহমান খাঁ ফুলপুরীকে উহার সেক্রেটারি করিলাম। কিন্তু ঐ মুসলিম-স্বার্থবাদী সাম্প্রদায়িক মুসলমান উকিল-মোখতারেরা মুসলিম লীগেও যোগ দিলেন না। কারণ তাঁদের মতে স্বয়ং জিন্না সাহেবও ছদ্র-কংগ্রেসী। সুতরাং মুসলিম লীগ আসলে কংগ্রেসেরই শাখা মাত্র। তাঁদের মতে আঞ্জুমনে-ইসলামিয়াই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সরকারের সমর্থনই মুসলমানদের একমাত্র পলিসি। ইংরাজরা না থাকিলে মুসলমানদের রক্ষা নাই।
মুসলমান শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই মনোভাবের মধ্যে কোনও যুক্তি ছিল না সত্য, কিন্তু ভণ্ডামিও ছিল না। আন্তরিকভাবেই তাঁরা বিশ্বাস করিতেন, ইংরাজের অবর্তমানে হিন্দু মেজরিটি শাসনে মুসলমানদের দুর্দশার চরম হইবে। জনৈক প্রবীণ খান সাহেব আমাকে বলিতেন : হিন্দুদের কাছে মুসলমান-প্রতিভারও কদর নাই। এই ধরুন না আমরা আপনাকে আঞ্জুমনের শীর্ষস্থানে বসাইয়াছিলাম। আর কংগ্রেস আপনাকে তিন নর ভাইস প্রেসিডেন্ট করিয়া রাখিয়াছে। কোনও দিন আপনেরে ওরা প্রেসিডেন্ট করিবে না কথাটা নিতান্ত চাছা-ছোলা কুড এবং মাকাঠিটা নিতান্ত স্কুল হইলেও কথাটার তলদেশে অনেক সত্য লুকায়িত ছিল। উহাই বাস্তব সত্য। কারণ বাস্তবজীবনে ঐ মাপিকাঠি দিয়াই সব জিনিসের বিচার হয়। অবস্থাগতিকে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তৎকালীন বিচারের মাপকাঠি ছিল উহাই। সম্ভবতঃ মধ্যবিত্তের বিচারের মাপকাঠি চিরকালই তাই।
২. কংগ্রেসের জমিদার-প্রীতি
পক্ষান্তরে কংগ্রেস কার্যতঃ ও নীতিতঃ প্রজা আন্দোলনের বিরোধী ছিল। ১৯২৮ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের বেলা কংগ্রেসী মেম্বররা যে একযোগে প্রজার স্বার্থের বিরুদ্ধে জমিদার-স্বার্থের পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন, এটা কোন এক্সিডেন্ট বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কংগ্রেস নেতারা প্রজা আন্দোলনকে শ্রেণী-সংগ্রাম বলিতেন। শ্রেণী সংগ্রামের দ্বারা দেশবাসীর মধ্যে আত্মকলহ ও বিভেদ সৃষ্টি করিলে স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাহত হইবে। এটাই ছিল তাঁদের যুক্তি। কিন্তু এ জিলার ব্যাপারে দেখা গেল, এটা তাঁদের মৌখিক যুক্তিমাত্র। ময়মনসিংহ জিলা কংগ্রেস-নেতৃত্বের উপর জমিদারদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বোম্বাই মাদ্রাজ যুক্ত প্রদেশ ও বিহার কংগ্রেস ঐ ঐ ঐ প্রদেশের কৃষকদের স্বার্থ লইয়া সংগ্রাম করিতেছে, এই সব যুক্তি দিয়াও আমি এ জিলার কংগ্রেস-নেতাদেরে টলাইতে পারিলাম না। লাভের মধ্যে আমি কংগ্রেসীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা ও সমর্থন হারাইলাম। তাঁদের যুক্তির মধ্যে প্রজা-আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাঁদের আসল মনোভাবটা ধরা পড়িত। তাঁরা প্রজা-আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলিতেন এবং যুক্তিতে বোৰাই-বিহারের কৃষক আনোলন হইতে ময়মনসিংহ তথা বাংলার প্রজা-আন্দেলনের পার্থক্য দেখাইতেন। বাংলার জমিদাররা প্রধানতঃ হিন্দু এবং প্রজারা প্রধানতঃ মুসলমান। জমিদারিতে যা মহাজনি ব্যাপারেও তাই। মহাজনরা প্রধানতঃ হিন্দু এবং খাতকরা প্রধানতঃ মুসলমান। সুতরাং এদের হিসাবে, এবং কার্যতঃ সত্যই, প্রজা আন্দোলন ছিল হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলন।