৪. মুসলিম-সংহতি ও প্রজা-সংহতির বিরোধ
কিন্তু এই স্নেহ বেশিদিন আমাকে রক্ষা করিতে পারিল না। আঞ্জুমনের কাজ ছাড়া আরও দুইটা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করিতাম। আমি ছিলাম জিলা প্ৰজা-সমিতির সেক্রেটারি এবং জিলা কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আঞ্জুমনের মধ্যে অনেক মুসলিম জমিদার থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মেম্বরই প্রজা এবং সেই হিসাবে প্রজা আন্দোলনের মোটামুটি সমর্থক। কিন্তু সকলেই একবাক্যে কংগ্রেসের বিরোধী। প্রজা আন্দোলনের জনপ্রিয়তা দেখিয়া বেশ কিছুসংখ্যক কংগ্রেস-কমী প্রজা সমিতির সমর্থক হই। প্রজা সমিতির সংগঠন উপলক্ষে আমি একটি কর্মী সম্মিলনী ডাকিলাম। আঞ্জুমনের সদস্যগণ আমাকে মুসলিম কমী সম্মিলনী ডাকিতে পরামর্শ দিলেন। আমি তাঁদেরে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম, আমার ডাকে কার্যতঃ শুধু মুসলমান কর্মীরাই আসিবেন। প্রজা সমিতি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হইলেও ইহাতে প্রধানতঃ মুসলমানরাই আছে। শুধু-শুধি সাম্প্রদায়িক সম্মিলনী ডাকার দরকার নাই। তাতে নাহক প্রজা সমিতিকে এবং প্রজা আন্দোলনকেও সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হইবে। আঞ্জুমনীরা আমার এই যুক্তি মানিলেন না। বরঞ্চ তাঁরা বলিলেন, প্রজাদের অধিকাংশই যখন মুসলমান, হিন্দুরা যখন প্রজা আন্দোলনে আসেই না, তখন নামে আর অসাম্প্রদায়িক প্রজা সমিতির দরকার কি? সোজাসুজি মুসলিম সম্মিলনী ডাকিলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে।
দৃশ্যতঃ তাঁদের কথাও সত্য। আমার ডাকা কর্মী সম্মিলনীতে মুসলমানরাই আসিবেন, হিন্দু কর্মীরা দূর হইতে মৌখিক সহানুভূতি দেখাইবেন। এ সমস্তই সত্য কথা। কিন্তু প্রজা সমিতির ও প্রজা আন্দোলনের আদর্শগত অসাম্প্রদায়িক রূপ আমরা নষ্ট করিতে পারি না। নিখিল-বংগ প্ৰজা-সমিতির অফিস-বিয়ারার সব মুসলমান হইলেও ডাঃ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, অধ্যাপক জে, এল, বানাজী, মিঃ অতুল গুপ্ত প্রভৃতি বড়-বড় হিন্দু মনীষী প্রজাদের দাবি-দাওয়া সমর্থন করিতেছিলেন। অবশ্য এ জিলার কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে শুধু মুসলমানরাই প্রজা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়াছেন। হিন্দু কংগ্রেসীদের মধ্যে যাঁরা জমিদারি-বিরোধী তাঁরা প্রজা-সমিতিতে যোগ না দিয়া কৃষক-সমিতি, কিষাণ সভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়াছেন। বাংলার প্রজা আন্দোলনকে এদের অনেকেই জোতদার আন্দোলন বলিয়া নিন্দা করিয়াছেন। নিছক কথা হিসাবে ওঁদের অভিযোগে অনেকখানি সত্য ছিল। কিন্তু আমার মতে ওঁদের ও-মত ছিল তৎকালের জন্য আন্ট্রা লেফটিযম। তৎকালীন কমিউনিস্ট ভাষায় শিশুসুলভ বাম পন্থা (ইনফেনটাইল লেফটিযম)। ঐ আল্টা-লেফটিযম প্রত্যক্ষভাবে না হইলেও পরোক্ষভাবে জমিদারি-বিরোধী আন্দোলনের ক্ষতি সাধন করিত পারিত। আমার ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে জমিদার-সমর্থক কোনও কোনও কংগ্রেস-নেতা ঐ উদ্দেশ্যেই ঐ আল্টা-লেফটিযমে উষ্কানি দিতেন। আমার জ্ঞান-বিশ্বাস মতে তৎকালীন প্রজা-আন্দোলনই ছিল প্রকৃত প্রস্তাবে যুগোপযোগী গণআন্দোলন। এ বিষয়ে তৎকালীন দক্ষিণ ভারতীয় কৃষক আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক রংগও আমাদের সহিত একমত ছিলেন। বাংলার কৃষক সমিতি ও কিযাণ সভার সাথে আমাদের প্রজা সমিতির পার্থক্যের দিকে তাঁর মনোযোগ আকৰ্ষণ করিলে তিনি আমাদের পথকেই ঠিক পথ বলিয়াছিলেন। এই জন্যই আমি বামপন্থীদের চাপ এড়াইয়া প্রজা-আন্দোলনই চালাইতেছিলাম। ফলে আমার জিলার প্রজা-সমিতি, চেহারা-ছবিতে একমত মুসলিম প্রতিষ্ঠান হইয়াই দাঁড়াইয়াছিল। এই দিক হইতে আমার আঞ্জুমনী বন্ধুদের কথাই ঠিক।
কিন্তু এর অন্য একটা দিকও ছিল। দেশের অর্থনৈতিক গণ-আন্দোলন হিসাবে ইহার অসাম্প্রদায়িক শ্রেণীরূপ বজায় রাখাও ছিল আবশ্যক। যতই অল্পসংখ্যক হোক এ জিলার দু’চারজন অকংগ্রেসী হিন্দু ভদ্রলোক প্রজা-আন্দোলনের গোড়া সমর্থক ও বিশ্বস্ত অনুগত সক্রিম্ম মেম্বর ছিলেন। এদের মধ্যে প্রবীণ মোখর শ্রীযুক্ত প্রমথ চন্দ্র বসু এবং উকিল শ্ৰীযুক্ত উমেশ চন্দ্র দেবনাথের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া দেশবিখ্যাত কতিপয় হিন্দু চিন্তাবিদ প্রজা-আন্দোলনের প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন। ইহাদের মধ্যে ডাঃ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, মিঃ অতুল চন্দ্র গুপ্ত, অধ্যাপক জে, এল, বানাজী ও অধ্যাপক বিনয় সরকারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাই আমি আঙুমনী বন্ধুদের চাপে টলিলাম না। কাজেই তাঁরাও আমার সম্মিলনীর বিরোধী হইয়া উঠিলেন। ক্রমে অবস্থা এমন দাঁড়াইল যে হয় সম্মিলনী পরিত্যাগ করিতে হয় অথবা আঞ্জুমনের সহ-সভাপতিত্ব ছাড়িতে হয়। আঞ্জুমনের প্রতি আদর্শগত কোনও আকর্ষণ আমার ছিল না। শহরের মুরুব্বি ও বন্ধু-বান্ধবরা আদর করিয়া একটা সম্মান দিয়াছিলেন। তাই নিয়াছিলাম। আজ তাঁরা সেটা ফেরত চাইলেন। আমি ফেরত দিলাম।
আঞ্জুমনীরা আমার কর্মী-সম্মিলনীর একই দিনে টাউন হলে এক মুসলিম সম্মিলনী আহ্বান করিলেন। আমি মনে করিলাম, ভাল কথা। ওঁদের সম্মিলনীতে যদি মফস্বল হইতে লোক আসে তবে সেখানেও প্রজাদের দাবিতে প্রস্তাব পাস হইবে। ফলে দুই সম্মিলনীই কার্যতঃ প্রজা-সম্মিলনী হইবে। কিন্তু আঞ্জুমানীরা তাঁদের সম্মিলনীকে সফল করার চেয়ে আমার সম্মিলনী ভাংগার দিকে অধিক মনোযোগ দিলেন। প্রথমে জিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়া ১৪৪ ধারা জারির চেষ্টা করিলেন। আমার সম্মিলনীর তারিখ বহুদিন আগে ঘোষিত হইয়াছে, আমি এই আপত্তি করায় জিলা ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধাজ্ঞা জারি করিলেন না। কিন্তু আঞ্জুমনীরা আমাকে কয়েদ করিয়া গুণ্ডামির দ্বারা আমাদের সম্মিলনী ভাংগিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। এই সব করিতে গিয়া তাঁরা সম্মিলনীকে কার্যতঃ অনেকখানি কংগ্রেসী কর্মী-সম্মিলন করিয়া ফেলিয়াছিলেন। ফলে কোনও সম্মিলনী না হওয়া সত্ত্বেও আমাদের পক্ষে খবরের কাগয়ে বাহির হইল? সাফল্যের সাথে সম্মিলনীর কার্য সমাপ্ত হইয়াছে। মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা সম্মিলনী পও করিবার যে সব চেষ্টা করিয়াছিল সে সবই ব্যর্থ হইয়াছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। ময়মনসিংহ জিলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটিয়াছে ইত্যাদি।